ঢাকা , বুধবার, জুলাই ২, ২০২৫

পাঠ্যপুস্তক বোর্ড : চেয়ারম্যান নেই তিনমাস, এক সদস্য গুরুত্বপূর্ণ তিন পদে

Jul ০১, ২০২৫
শিক্ষা
পাঠ্যপুস্তক বোর্ড : চেয়ারম্যান নেই তিনমাস, এক সদস্য গুরুত্বপূর্ণ তিন পদে

নিজস্ব প্রতিবেদক : চলতি বছরের জন্য পাঠ্যবই ছাপা ও বিতরণ নিয়ে চরম বিপাকে অন্তর্বর্তী সরকার। বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়া সম্ভব হয়নি। শিক্ষাবর্ষের প্রায় চারমাসের মাথায় এপ্রিলে সব বই বিতরণ শেষ হয়। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।

এজন্য ২০২৬ সালের জন্য প্রায় ৩০ কোটি পাঠ্যবই ছাপানোর কার্যক্রম আগেভাগেই শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। আগামী ৩০ অক্টোবরের মধ্যে সব বই ছাপিয়ে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে দেশের ৫৮৫টি কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে এনসিটিবি।

তবে বিপত্তি অন্য জায়গায়। বই ছাপা ও বিতরণের কার্যক্রম আগেভাগে শুরু করলেও তা বাস্তবায়নে দেখা দিয়েছে নানামুখী সংকট। যে সময়ে এনসিটিবি পাঠ্যবইয়ের টেন্ডার ও পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজ করছে, ঠিক সেসময় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানসহ শীর্ষ পাঁচটি পদ শূন্য। ফলে টেন্ডার মূল্যায়ন, কাজ বণ্টন, পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতসহ বিভিন্ন কাজে বিঘ্ন ঘটছে। ছোট ছোট সিদ্ধান্ত অনুমোদন করতে ছুটতে হচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। এছাড়া এনসিটিবির বোর্ড সভাও হয়নি দীর্ঘদিন। এনসিটিবির মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম বিভাগের সদস্য অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী একাই তিন দায়িত্ব পালন করছেন।

পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, পাঠ্যবই ছাপানোর কার্যক্রম পুরোদমে শুরুর সময়ে একজন নিয়মিত চেয়ারম্যান না থাকায় তাদের চরম নেতৃত্ব সংকটে ভুগতে হচ্ছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণেও বেগ পোহাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। কী কারণে চেয়ারম্যান পদে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না, তা নিয়েও চলছে জল্পনা-কল্পনা।

এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসানের মেয়াদ শেষ হয় গত ২৫ মার্চ। এরপর থেকে পদটি শূন্য। চেয়ারম্যানের অতিরিক্ত দায়িত্ব সামলাচ্ছেন অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী। অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা চেয়ারম্যান অনেক সিদ্ধান্তই নিতে পারেন না। ফলে প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় নানামুখী সংকট তৈরি হচ্ছে।

দীর্ঘদিন বোর্ডসভা হয়নি। এখন যে ধরনের কার্যক্রম চলছে, তাতে জরুরি বোর্ডসভা করার প্রয়োজন পড়েছে বলে আমার জানা নেই।-সচিব মো. সাহতাব উদ্দিন

পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের প্রাথমিক শিক্ষাক্রম বিভাগের সদস্যপদ কয়েক মাস ধরে ফাঁকা। প্রাথমিকের ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ পদটিও শূন্য। এছাড়া মাদরাসা শাখার ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ ও গবেষণা কর্মকর্তা পদে দীর্ঘদিন ধরে কেউ নেই। অথচ মাদরাসার শিক্ষাক্রম পরিমার্জনসহ ঝুলে থাকা অনেক কাজে দীর্ঘদিন কারও হাত পড়েনি। এর বাইরে আইসিটি সেলের প্রধানের পদটিও শূন্য।

জানতে চাইলে এনসিটিবির সচিব অধ্যাপক মো. সাহতাব উদ্দিন বলেন, ‘পদগুলো শূন্য। এসব পদে বিভিন্নজনকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া আছে। তারা কাজগুলো যথাসম্ভব গুরুত্ব দিয়ে করার চেষ্টা করছেন।’

একাই তিন পদে, বোর্ড সভায় ‘একক কর্তৃত্ব’

নিয়মিত চেয়ারম্যান না থাকায় এ পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন এনসিটিবির মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম বিভাগের সদস্য অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী। চেয়ারম্যান পদে অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকায় ‘পদাধিকার বলে’ তিনিই আবার প্রাথমিকের শিক্ষাক্রম বিভাগের সদস্য। ফলে এক ব্যক্তি এখন এনসিটিবির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিন পদে দায়িত্ব পালন করছেন।

এনসিটিবির কর্মকর্তাদের অভিযোগ, টেন্ডারের পর কাজ পেতে এনসিটিবিতে ব্যাপক তদবির চলছে। যারা টেন্ডার ড্রপ করেছেন, তাদের সক্ষমতা, কাজের মান ও ধরনসহ বিভিন্ন বিষয় মূল্যায়ন চলছে। এ মূল্যায়নে চেয়ারম্যান, সদস্য এবং উৎপাদন ও বিতরণ নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা থাকে। তবে চেয়ারম্যান ও দুটি সদস্যপদে একাই অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী দায়িত্ব পালন করায় তার কর্তৃত্বই বেশি।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৩ (সংশোধিত ২০১৮) অনুযায়ী- এনসিটিবির ৯ সদস্যের একটি বোর্ড থাকবে। এ বোর্ডের সভাপতি থাকবেন চেয়ারম্যান। বাকি ৮ সদস্য হলেন- সদস্য (পাঠ্যপুস্তক), সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম), মাদরাসা শিক্ষাক্রমের প্রধান, কারিগরি শিক্ষাক্রমের প্রধান, শিক্ষাক্রম প্রশিক্ষণের একজন, শিক্ষাক্রম গবেষণা, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের একজন এবং সদস্য অর্থ বিভাগ।

আমি মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমের মেম্বার। আমার কাজটা হলো মাধ্যমিকের অর্থাৎ, ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষাক্রম নিয়ে। চেয়ারম্যান পদ শূন্য থাকায় সরকার আমাকে সেখানে অতিরিক্ত দায়িত্বে বসিয়েছে। এটা আমি চেয়ে বা তদবির করে নিইনি।- অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী

বর্তমানে চেয়ারম্যান, সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) এবং মাদরাসা শিক্ষাক্রমের প্রধান পদগুলো শূন্য। তাছাড়া সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) দীর্ঘদিন দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। ফলে বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ চারজন সদস্য অনুপস্থিত। এমন পরিস্থিতিতে কোনো বোর্ডসভা করা সম্ভব হচ্ছে না।

অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী- এনসিটিবির বোর্ডসভায় শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, পরিমার্জন, পাণ্ডুলিপি প্রণয়ন, পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ, প্রকাশনা ও বিতরণ কার্যক্রমের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভা না হওয়ায় অনেক সিদ্ধান্ত অনুমোদন আটকে আছে। আবার অনেক সিদ্ধান্ত বোর্ডসভা এড়িয়ে একক সিদ্ধান্তে করা হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে বলেও জানান বোর্ডের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা।

সচিব মো. সাহতাব উদ্দিন বলেন, ‘দীর্ঘদিন বোর্ডসভা হয়নি। এখন যে ধরনের কার্যক্রম চলছে, তাতে জরুরি বোর্ডসভা করার প্রয়োজন পড়েছে বলেও আমার জানা নেই।’

এনসিটিবির সাবেক একজন চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘বোর্ডে যে সিদ্ধান্তগুলো হয়, তাতে চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তের প্রাধান্য বেশি থাকে। চেয়ারম্যান যে সিদ্ধান্ত নেন, তাতে সবাই অনেকটা বাধ্য হয়ে সায় দেন। মাঝে-মধ্যে দু-একজন সদস্য নোট অব ডিসেন্ট দেন। সেটা প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষাক্রম এবং অর্থ বিভাগের সদস্য। অন্য যারা থাকেন, তারা সব সময় একটু ডাউন থাকেন।’

‘কিন্তু এখন তো যিনি চেয়ারম্যান, তিনিই মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমের সদস্য; আবার তিনিই প্রাথমিক শিক্ষাক্রম বিভাগের রুটিন দায়িত্বের সদস্য। অনেকটা খেলোয়াড় যিনি, রেফারিও তিনিই। এমনটা হলে কর্তৃত্ব থাকবেই’ যোগ করেন সাবেক ওই চেয়ারম্যান।

কোনো প্রভাব খাটানোর সুযোগ নেই, উল্টো ঠিকমতো কাজ করতে হিমশিম খাচ্ছেন বলে দাবি করেছেন অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এনসিটিবির চেয়ারম্যান পদে বসা অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী বলেন, ‘আমি মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমের মেম্বার। আমার কাজটা হলো মাধ্যমিকের অর্থাৎ, ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষাক্রম নিয়ে। চেয়ারম্যান পদ শূন্য থাকায় সরকার আমাকে সেখানে অতিরিক্ত দায়িত্বে বসিয়েছে। এটা আমি চেয়ে বা তদবির করে নিইনি।’

বিষয়টি শিক্ষা উপদেষ্টা অবগত। বর্তমানে সেখানে একজন অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। মন্ত্রণালয় থেকেও তাদের সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত যাতে সেখানে একজন নিয়মিত চেয়ারম্যানকে পদায়ন করা যায়।- শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের

অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষাক্রমের সদস্য পদে যে রুটিন দায়িত্ব সেটা চেয়ারম্যান পদে অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকায়, সেটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমার কাঁধে এসে পড়েছে। সরকার বিষয়গুলো নিশ্চয়ই অবগত। শূন্য পদে নিয়োগ হলে এগুলোতে আমাকে আর অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হবে না।’

পাঠ্যবই ছাপানোর ‘ভরা মৌসুমে’ এনসিটিবির মতো প্রতিষ্ঠানে চেয়ারম্যানসহ গুরুত্বপূর্ণ পদ শূন্য রাখার বিষয়ে জানতে শিক্ষা উপদেষ্টা চৌধুরী রফিকুল আবরারের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে এনসিটিবি তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের বলেন, ‘বিষয়টি শিক্ষা উপদেষ্টা অবগত। বর্তমানে সেখানে একজন অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। মন্ত্রণালয় থেকেও তাদের সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত যাতে সেখানে একজন নিয়মিত চেয়ারম্যানকে পদায়ন করা যায়। আশা করি, সেটা সম্ভব হবে। দ্রুত বই ছাপানো শেষে বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে নেওয়া যাবে।’

২০২৬ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের জন্য ছাপানো হবে ৮ কোটি ৫২ লাখ ৫৩ হাজার ২৪ কপি বই। এতে খরচ হবে প্রায় ৪২৩ কোটি টাকা। আর মাধ্যমিকে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ছাপা হবে ২১ কোটি ৪০ লাখ পাঠ্যবই। এতে ব্যয় হবে প্রায় এক হাজার ৫৬ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে এ বছর প্রায় ৩০ কোটি বই ছাপার কাজে ব্যয় ধরা হয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকা।

গত বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক মিলিয়ে প্রায় ৪০ কোটি পাঠ্যবই ছাপানো হয়। এতে ব্যয় হয়েছিল দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে মাধ্যমিকের বই ছাপাতে প্রায় এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা এবং প্রাথমিকের বই ছাপাতে খরচ হয়েছিল প্রায় সাড়ে চারশ কোটি টাকা।

এনসিটিবির সচিব অধ্যাপক মো. সাহতাব উদ্দিন বলেন, ‘সব শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের টেন্ডার হয়ে গেছে। কয়েকটি শ্রেণির কাজ পেতে প্রতিষ্ঠানগুলো টেন্ডার ড্রপ করেছে। সেগুলো মূল্যায়ন চলছে। শিগগির আনুষঙ্গিক কার্যক্রম শেষে বই ছাপানোর কাজ শুরু করা হবে।’

এনডিটিভিবিডি/০১ জুলাই/এএ

 

সর্বশেষ সংবাদ

আলোচিত সংবাদ