নোংরা আর যেখানে-সেখানে রয়েছে ময়লার স্তূপ
হাসপাতালই যেন মশার বংশবিস্তারের কারখানা!
# চত্বরেই জমে আছে বৃষ্টির পানি
এসএম শামসুজ্জোহা, ঢাকা থেকে :
রাজধানীঢাকা ছাড়িয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। দেশের হাসপাতালগুলোতে দিনে দিনে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। অথচ সেই হাসপাতালই হয়ে উঠেছে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রজনন ও বিচরণ ক্ষেত্র। ডেঙ্গির প্রকোপ রুখতে সচেতনতার যাবতীয় প্রচার যেন রয়ে গিয়েছে স্রেফ কথাতেই। অধিকাংশ সরকারি হাসপাতাল চত্বরেই জমেআছে বৃষ্টির পানি; বংশবিস্তার করছে মশা। রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকার হাসপাতাল ঘরে দেখা গেল এমনই নানা চিত্র। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি বছর সাতেক আগে যাত্রা শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠানের সব ভবনই নতুন। তবে ভবনের ভেতরে-বাইরে পুরোনো ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি।
পানি জমে থাকে যেখানে-সেখানে। সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা বলেছে, এই প্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গুর ভাইরাসবাহী এডিস মশা আছে ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে রয়েছে। হাসপাতালের ভেতরে-বাইরে ৮০ শতাংশ পাত্রে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এই হাসপাতালের ভেতরে-বাইরে মশা জন্মানো ও বংশ বিস্তারের উপযুক্ত পরিবেশ রয়েছে। হাসপাতালের মূল ভবনে ঢোকার মুখে চোখে পড়ল মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ শাহ গোলাম নবীর নামে একটি ব্যানার। তাতে লেখা, ‘আপনার বাড়ী-ঘরের অপ্রয়োজনীয় পরিষ্কার পানি ফেলে দিন; ব্যবহার্য পানি
ঢেকে রাখুন।’ এডিস মশা ও ডেঙ্গু জ্বরের ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করার জন্য অধ্যক্ষ এই বার্তা লিখে রেখেছেন। তবে এলাকাবাসী ও হাসপাতালের কর্মকর্তারা জানালেন, বৃষ্টি হলেই হাসপাতালের সামনের রাস্তায় পানি জমে যায়। ভেতরের চত্বরেও পানি জমে থাকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেখানে প্রতিদিনই কয়েকশ’ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন সেখানে মশা নিধনে কোনো ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালের চিকিৎসকরা নানা উপদেশ দিলেও নিজেরাই মানছেন না। উল্টো হাসপাতালের আশপাশে ডেঙ্গুর বংশবিস্তারের নির্বিঘœ স্থান তৈরি করা হচ্ছে। রোগীদের অভিযোগ, এ ব্যাপারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। হাসপাতালের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরাও দায়সারা কাজ করেন। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ‘আমরা প্রতিটি হাসপাতালকে পরিষ্কার- পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছিলাম। এটা তারা পালনও করেছে। তবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা দৈনন্দিন ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে প্রতিদিন নজরদারি করা যায় না। দু-একটি নজরের বাইরে থেকে যাওয়া সম্ভব। তবে আমরা আন্তরিক।’ সরেজমিনে হাসপাতালগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, দেশের অধিকাংশ
সরকারি হাসপাালগুলোর চারদিকে নোংরা আর যেখানে-সেখানে রাখা ময়লার স্তূপ।
এসব ময়লায় জন্ম নিচ্ছে মশা, সঙ্গে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধও। রোগীরা চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে গেলেও ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধে উল্টো স্বাস্থ্যঝুঁঁকি নিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে একাধিক
হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয়া একাধিক রোগীর স্বজনদের অভিযোগ। তারা বলছেন, হাসপাতালেই মশার কামড় খাচ্ছেন রোগী থেকে নিরাপত্তাকর্র্মী সকলেই। কোথাও ট্যাঙ্কের পানি উপচে পড়ে জমা হয়েছে প্লাস্টিকের ব্যাগে। আবার নির্মীয়মাণ আবর্জনার অংশে জমা পানি দেখে ডেঙ্গির ভয়ে হাসপাতালের প্রতীক্ষালয়ে রাত কাটাচ্ছেন
রোগীর পরিজনেরা। ঢামেক হাসপালের এক রোগীর অভিযোগ, হাসপাতালের কর্মীরাই ব্যবহৃত ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ কিংবা ওষুধের প্লাস্টিক উপর থেকে ছুড়ে ফেলছেন নীচে। বৃষ্টির পরে সেই আবর্জনাতেই পানি জমছে। দেশের যে সব হাসপাতালে প্রতিদিনই কয়েক’শ রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। যেখানে ডেঙ্গুবাহিত মশাসংক্রান্ত ব্যাপারে ও
নিধনে হাসপাতালের চিকিৎসকরা নানা উপদেশ দিলেও নিজেরাই মানছেন না সেসব উপদেশ। উল্টো হাসপাতালের আশপাশে ডেঙ্গুর বংশবিস্তারের নির্বিঘœ স্থান তৈরি করা হচ্ছে। তৈরি করা হচ্ছে জলাবদ্ধতা। এ ব্যাপারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তেমন ভ্রæক্ষেপ নেই বলে জানালেন একাধিক রোগী। হাসপাতালটিতে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরাও ইদানীং দায়সারা কাজ করেন। আবার কখনো হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকারও অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা একাধিক রোগী ও তার স্বজনরা জানান, যে হাসপাতালে শত শত ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দেয়া হয়। সেখানেই যদি ডেঙ্গু মশা বিস্তারের স্থান তৈরি করা হয়; সেটা কষ্টদায়ক। এ-সংক্রান্ত কিছু বললে লোকবলের সংকটের অজুহাত দেখিয়ে কর্মচারীরা রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন। আবার কেউ কেউ রোগীদের ট্রলি টেনে টাকা নিচ্ছেন। টাকা না দিলে ট্রলির সেবা দিতে নানা অজুহাত দেখান তারা। তাদের কারোরই হাসপাতালটির পরিষ্কারের দিকে তেমন নজর নেই। এসব বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যাল ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. জুলফিকার আহমেদ আমিন বলেন, সরকারি হাসপাতালগুলো নিয়মিতই পরিষ্কার করা হয়; এটা রুটিন ওয়ার্ক। অপরিষ্কার হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে রোগীরা ওষুধের প্যাকেট, খাবারের অবশিষ্ট অংশ ও নানা ময়লা-আবর্জনা যেখানে-সেখানে ফেলার কারণে মাঝেমধ্যে
আমাদের কিছুটা সমস্যা পোহাতে হয়। তবে রোগী ও তাদের স্বজনদের একটু সচেতনতা এ সমস্যা সমাধানে বড় ভ‚মিকা রাখতে পারে। আর ডেঙ্গু মশার বংশবিস্তারে জলাবদ্ধতা ও আবর্জনার বিষয়টি স্বীকার করতে নারাজ তিনি।
তবে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক প্রফেসর ড. এ. কে. এম. মুজিবুর রহমান বলেন, আমরা সবসময়ই বলে আসছি ডেঙ্গু মোকাবেলার জন্য সবচাইতে জরুরি বিষয় হলো- জনগণের সচেতনতা। অথচ দেখা যায়; অনেকেই এমন খোসা ফেলছে বিভিন্ন দিকে, আবার কেউবা বোতল ফেলে রাখছে যেখানে-সেখানে। তবে এটা বলে আমাদের নিজেদের চেষ্টার কোনো কমতি আমরা রাখি না। তবে তিন দিন ধরে ডাবের খোসা বা বোতল পড়ে থাকবে বিষয়টা কিন্তু তাও না। হাসপাতালের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য আমরা সবসময়ই সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাই। পরিচালক বলেন, আমাদের হাসপাতালে আমরা প্রতিদিন ৬ জন লোককে নিয়োগ করেছি শুধু বাইরের দিক পরিষ্কার করার জন্য। তাদের আমরা আলাদাভাবে পেমেন্ট করছি শুধু বাইরের দিক পরিষ্কার করার জন্য। যদি বাইরে কোনো ময়লা জমেও যায়; তাহলে সেটা পরিষ্কার করাই তাদের কাজ। সুতরাং ময়লা জমে থাকার সুযোগ খুবই কম। হাসপাতাল প্রাঙ্গণে থাকা ভ্যানে করে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তাদের আমরা বের করার চেষ্টা করি; তারা বেরও হয়ে যায় কিন্তু পরে দেখা যায় আবার এসে দোকান শুরু করে। তবে একটা বিষয় হলো যেখানে ডিমান্ড থাকবে সেখানে সাপ্লাইও থাকবে। আর তাই হয়তো সেই দোকানিরাও
বারবার আসে। জনগণ যদি সচেতন না হয় তবে আসলে এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ খুবই কঠিন।’ হাসপাতালের পাশে থাকা ময়লা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মেডিকেল কলেজ
এবং হাসপাতালের মাঝামাঝি স্থানে কিছু ময়লা আছে। তবে সেগুলো আমাদের কিছু নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়ের কাজ চলছে সেগুলোর ময়লা। এ সময় তিনি ময়লার সঙ্গে এডিসের কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেন এবং বলেন পানি জমে থাকার সুযোগও খুব বেশি নেই। তিনি বলেন, হাসপাতালে আমরা রোগীদের সেবা দেয়াকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। তাও আমরা চেষ্টা করি সব দিক থেকে হাসপাতালকে নিরাপদে রাখার জন্য। ##