শত বাধা পেরিয়ে এগোচ্ছে নারী টেকসই গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশে নতুন মাত্রা দ্রæত বাড়ছে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ
# গত এক দশকে নারী শ্রমিক বেড়েছে ১১৬% এবং কৃষিতে গ্রামীণ নারীর অংশগ্রহণ ৭২.৬ শতাংশ
এসএম শামসুজ্জোহা, থেকে :
বিশ্বের কৃষিপ্রধান দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ সবচেয়ে দ্রæত বাড়ছে। বৈশ্বিক গড় হারের চেয়ে এখন বেশি নারী দেশের কৃষি খাতে জড়িত। তবে মোবাইল ফোন সেবা, ইন্টারনেট প্রযুক্তি থেকে শুরু করে জমির মালিকানায় তারা এখনও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যেও সীমিত সুযোগ কাজে লাগিয়ে তারা কৃষিতে বিরাট অবদান রাখছেন। জানা যায়, দেশের মোট নারী শ্রমশক্তির ৭৫ শতাংশ গ্রামে কাজ করে।
আর কৃষি, বনায়ন ও মৎস্য খাতে কাজ করে নারীদের ৭২.৬ শতাংশ। কৃষিতে নারীর এই বিপুল অংশগ্রহণের পরও সরকারের দেয়া কৃষক
কার্ড পাচ্ছেন না নারীরা। তথ্য মতে, দেশের কৃষি শ্রমিকের প্রায় ৪০ শতাংশই নারী। যদিও বাংলাদেশে মোট কৃষি শ্রমিকে নারীর অবদান ক্রমবর্ধমানহারে বাড়ছে। গত এক দশকে কৃষিতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১১৬ শতাংশ। পেশা বদল ও বহুমুখী পেশায় যুক্ত হওয়ার
সুযোগ তৈরি হওয়ায় কৃষিতে পুরুষ শ্রমিকের অংশগ্রহণ ১০ শতাংশ কমেছে। আদি পেশা কৃষির সূচনা হয় নারীর হাত ধরেই। ঘরের কাজের
পাশাপাশি তারা কৃষি কাজও করে আসছে বহুকাল থেকে। আগে গ্রামীণ সমাজে পুরুষরাই মাঠে কৃষি কাজ এবং নারীরা
রান্নাবান্না আর সন্তান লালনপালন নিয়েই ব্যস্ত থাকতো। বর্তমানে প্রত্যক্ষভাবে কৃষিকাজে এগিয়ে এসেছে নারীরা। তারা পুরুষের সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে। খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি উৎপাদন বিশেষ করে রবিশস্য উৎপাদন, গবাদি পশু ও হাঁস- মুরগি পালন, সবজি ও মৎস্য চাষ, বনায়ন এসব কাজে নারীরা পুরুষের পাশাপাশি সমান অবদান রাখছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, বাংলাদেশের নারীরা ঐতিহাসিকভাবে কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। ফসল কাটার পর তা মাড়াই; রক্ষণাবেক্ষণসহ বেশির ভাগ কাজ তারাই করে থাকেন। কিন্তু পরিবারের নেতৃত্ব এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের ভ‚মিকা থাকে কমই। গত কয়েক যুগে পরিবারে নারীর ভ‚মিকা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ফসলের ক্ষেতে ধানের বীজ বপন করা থেকে শুরু করে সার দেয়া, আগাছা দমন, কীটনাশক ছিটানো, ধান কেটে ঘরে তোলাসহ সব কাজই নারীরা করছে। অনেকেই আবার বাড়ির পাশে কিংবা উঠানে অনাবাদি জায়গায় শাক-সবজি, ফলফলাদির আবাদ করে সংসারে বাড়তি রোজগারের পথ করে নিচ্ছে। এতে পরিবারের খরচ মিটানোর পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও তাদের অবদান বাড়ছে।
দেশের একটি সমৃদ্ধ খাত চা-শিল্প। এখানে পাহাড়ি নারী চা শ্রমিকদের অবদান অনস্বীকার্য। এ ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলে চিংড়ি চাষ, হাঁস-মুরগি পালন থেকে শুরু করে আজকে কৃষির প্রায় সব ক্ষেত্রেই নারীর অবদান বাড়ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃষি সম্প্রসারণ সেবা কার্যক্রমের আওতায় উদ্ভাবিত নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে নারীরা অত্যন্ত নিষ্ঠা ও দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। কৃষি তথ্য জরিপ অনুসারে, দেশের মোট শ্রমশক্তির উল্লেখযোগ্য একটি অংশ নারী। নারী শ্রমশক্তির মধ্যে ৬৮ শতাংশই কৃষি, বনায়ন ও মৎস্য খাতের সঙ্গে জড়িত। কর্মক্ষম নারীদের মধ্যে
সবচেয়ে বেশি নিয়োজিত রয়েছেন কৃষি কাজে।
বলা চলে, কৃষি ও এর উপখাতের মূল চালিকাশক্তি নারী। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পরিসংখ্যানে নারীর এ উপস্থিতির হিসাব নেই। বাংলাদেশের নারীরা যে কৃষিতে বিপুল অবদান রাখছেন, গবাদিপশু খাতে নজর দিলেই এর প্রমাণ মেলে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য বলছে, এবার কোরবানিতে গবাদিপশুর বড় অংশ এসেছে প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিদের কাছ থেকে। দেশে এমন প্রায় ১০
লাখ খামার রয়েছে, যার প্রায় ৬০ শতাংশ চালান গ্রামীণ নারীরা। বাংলাদেশ তো বটেই; বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত বø্যাক বেঙ্গল ছাগলের
৯০ শতাংশ লালন-পালন করেন নারীরা। এ বিষয়ে জেন্ডারি বিশেষজ্ঞ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শরমিন্দ নিলোর্মী বলেন, সারা দেশে কৃষি, হাঁস-মুরগি পালন, সিলেট- চট্টগ্রাম-পঞ্চগড়ে চা এবং দক্ষিণাঞ্চলে চিংড়ি চাষে নারীর অবদান বাড়ছে। কৃষির উপখাতের মূল চালিকাশক্তিও কিন্তু নারী। তিনি বলেন, এখনো গ্রামীণ সমাজে কৃষি ও চাষের কাজকে নারীর প্রতিদিনের কাজের অংশ বলে বিবেচনা করা হয়। বিবিএসের সর্বশেষ কৃষিশুমারির তথ্য বলছে, বাংলাদেশে মোট ৯৮ শতাংশ পরিবার পল্লী এলাকায় বসবাস করে। যার মধ্যে ৫৩.৮২
শতাংশ কৃষি পরিবার। এলএফএসের তথ্য মতে এক দশকে অর্থনৈতিক কর্মকাÐের সঙ্গে যুক্ত প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ বাড়তি শ্রমশক্তির ৫০ লাখই নারী শ্রমিক। এ সময় দেশে কৃষি, বন ও মৎস্য খাত এবং পশু ও হাঁস-মুরগি পালন প্রভৃতি কাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৩৭ লাখ থেকে বেড়ে প্রায় ৮০ লাখ হয়েছে। এ বৃদ্ধির হার ১১৬ শতাংশ। যদিও এসব নারী শ্রমিকের ৮০ শতাংশই অবৈতনিক ও পারিবারিক শ্রমিক। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য কৃষিতে নারী শ্রমিকের অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করা প্রয়োজন।
এ ব্যাপারে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, কৃষি খাতে নারীর কাজকে আর্থিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। তারা পারিবারিক কৃষির অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেও বিনিময়ে কোনো পারিশ্রমিক পান না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কৃষিকাজে নারীরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া বাড়িয়েছেন। যে কারণে অন্যান্য খাতেও তাদের ভ‚মিকাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। শুধু
উৎপাদন নয়, কৃষিপণ্য বাজারে পৌঁছানো এবং বিক্রিসহ সব কাজে তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। এ জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোকে কৃষি খাতে নারী উদ্যোক্তা তৈরির জন্য প্রশিক্ষণ ও সহায়তা বাড়াতে হবে। ##