আগামী বছরের শুরুতেই বিদেশি বিনিয়োগের বড় সুযোগ আসছে বাংলাদেশে
শিল্পসহ নানা খাতে বাংলাদেশকে এখন বিনিয়োগের জন্য উত্তম বিবেচনা করছে উন্নত বিশ্ব
স্টাফ রিপোর্টার :
শিল্পসহ নানা খাতে বাংলাদেশকে এখন বিনিয়োগের জন্য উত্তম বিবেচনা করছে উন্নত বিশ্বের অনেক দেশ। বিদ্যুৎ, জ্বালানি, শিল্প খাতের এর আগে নানা বিনিয়োগ আসলেও এবারই প্রথম স্বাস্থ্য খাতে বড় বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে কয়েকটি দেশ। এর মধ্যে প্রতিবেশী দেশ ভারত ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে এক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বাংলাদেশে উন্নতমানের একটি হাসপাতাল গড়ার।
পাশাপাশি বন্ধুরাষ্ট্র চীন ও সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ কিংবা থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালের মানের হাসপাতাল গড়তে প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ সরকারের কাছে। এর বাইরে স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে তুরস্ক এবং সৌদি আরবও। সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছরের শুরুতেই স্বাস্থ্য খাতে বড় বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে আরও বেশি বিনিয়োগ করার জন্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহŸান জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্প্রতি ঢাকায় বাংলাদেশ বিজনেস সামিট উদ্বোধন করার সময় তিনি বলেছেন, ‘আপনারা আসুন, বিনিয়োগ করুন, বাংলাদেশ সবসময় প্রস্তুত আপনাদের আগমনের জন্য।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, বাংলাদেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই এসেছে ৪৭০ কোটি ৮০ লাখ ডলার। জুন ২০২৩ সালের হিসাবে দেশে বর্তমানে মোট এফডিআই রয়েছে ২ হাজার ৫৫ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। আগের বছরের তুলনায় এফডিআই প্রায় ৫ শতাংশ বেড়েছে। তবে বাংলাদেশের বিনিয়োগ উন্নয়ন বোর্ড এবং অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য এই দেশে বিনিয়োগের অনেক সুযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া বলেন, এখন আর বিদেশি
বিনিয়োগে কোন চ্যালেঞ্জ নেই। বিচ্ছিন্নভাবে তো বলতে হবে না। আমরা বেশিরভাগ সেবাই ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দিতে পারছি। সবাই তো হ্যাপি। গত চারমাসে ৪১ জন রাষ্ট্রদূত এসেছে, সবাই তো প্রশংসা করেছে, নেগেটিভ তো কেউ বলে নাই। তিনি বলেন, দেশে বিজনেস বান্ধব পরিবেশ তৈরির জন্য সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সবাইকে নির্দেশ দেয়া আছে; সবাই সেভাবে কাজ করছে।
বাংলাদেশে যে বিনিয়োগকারীরা রয়েছেন তারা বলছেন, আগের তুলনায় ব্যবসা পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে সকল খাতে ডিজিটাল সেবা ব্যবস্থা পুরোপুরি চালু করা দরকার। সেটা হলে দীর্ঘসূত্রিতা এবং অস্বচ্ছতা কমে যায়। আগের চেয়ে অনেকগুলো ধাপ কমেছে; তবে আরও কিছু করার প্রয়োজন রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ রূপকল্প-২০৪১ সালের যে পরিকল্পনা নিয়েছে। সেখানে অবকাঠামো খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে। তথ্য মতে, বাংলাদেশে এখন জ্বালানি, পানি, লজিস্টিক এবং পরিবহন খাতে ৩৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অবকাঠামো গড়ার সুযোগ রয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে শুধুমাত্র লজিস্টিকস খাতই ৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজারে পরিণত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। গত বছর ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট সামিটে যেসব সুপারিশ করা হয়েছিল, তার মধ্যে রয়েছে দেশের বন্দরগুলো উন্নয়ন ও পরিচালনায় বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা, পরিবহন খাত বিনিয়োগের জন্য উম্মুক্ত করা এবং আন্তর্জাতিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত পিপিপি কাঠামো তৈরি করা। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে ৩৮টি হাই-টেক পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে, যেগুলো বিদেশি বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। বাংলাদেশে প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজার শিক্ষিত ও দক্ষ ফ্রিল্যান্সার রয়েছে; যা বিশ্বে অনলাইন শ্রমের জন্য দ্বিতীয় বৃহত্তম। ফলে বাংলাদেশের সরকার আশা করছে, ২০২৫ সালের মধ্যে এই খাতে রপ্তানি আয় পাঁচ বিলিয়ন ডলারে পরিণত হবে। এর বড় একটি অংশ আসবে বিদেশি বিনিয়োগ থেকে। এছাড়া বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে মানুষের আয় বাড়ার কারণে গৃহস্থালি বিলাসদ্রব্য এবং ইলেকট্রনিক পণ্যের চাহিদা বেড়েছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, বাংলাদেশে যেভাবে অভ্যন্তরীণ বাজার বড় হচ্ছে; সেটা এমনকি সিঙ্গাপুরের কয়েকগুণ বড়। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভোগ্যপণ্য ব্যবহার বেড়েছে এবং বড় চাহিদা তৈরি হয়েছে। সেজন্য অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী এর
মধ্যেই সেটা লক্ষ্য করে আসতে শুরু করেছে, এখানে আরও ব্যবসার সুযোগ আছে। বাংলাদেশে গত এক দশকে স্বয়ংস্ক্রিয় ও হালকা প্রকৌশল জাতীয়
শিল্পের বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে। বিশাল করে অনেক বড় বড় শিল্প কারখানা গড়ে ওঠায় এসব সহযোগী শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে সারা দেশ জুড়ে। বাংলাদেশে গাড়ির ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ থেকে শুরু করে কৃষি ও নির্মাণ কাজের যন্ত্রপাতি, প্লাস্টিক পণ্যের ছাঁচ, নাট-বল্টু, বেয়ারিং ইত্যাদি অনেক কিছুই এখন তৈরি করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ আমদানি করে বাংলাদেশে গাড়ির যন্ত্রাংশ, ধান মাড়াই মেশিন, প্রকৌশল
যন্ত্রপাতি, নানারকম খেলনা তৈরি করা হয়। গত অর্থবছরে এই খাত থেকে ৭৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, এই খাতে আরও সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশে শ্রমবাজারের খরচ কম হওয়ায় এই খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করাকে বিশেষ জোর দেয়া যেতে পারে। বর্তমানে শিপ বিল্ডিং খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার ওপরেও জোর দিচ্ছে সরকার। সূত্র মতে, বাংলাদেশ প্রায় পাঁচ বছর আগে মিয়ানমার ও ভারতের সাথে বিবাদ মিটিয়ে বিশাল সমুদ্রসীমা, অর্থনৈতিক অঞ্চল পেলেও এখনো সেটার পুরোপুরি ব্যবহার শুরু করতে পারেনি। প্রতিবেশী দেশগুলো তাদের সমুদ্রে বহুদিন আগে থেকেই অনুসন্ধান, সম্পদ আহরণ শুরু করেছে। এটাকে আমরা অনেকদিন অবহেলা করেছি, এখন হয়তো কিছুটা গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে,
কিন্তু আমদানি লবির সুবিধার কারণে এটাকে এতদিন সামনে আনা হয়নি।
কিন্তু এখানে বিশেষ করে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বিদেশি বিনিয়োগের বিশাল সুযোগ রয়েছে। সেই সঙ্গে সমুদ্রে মৎস্য সম্পদ আহরণেও বাণিজ্যিক খাতে বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। ফরেন ইনভেস্টর্স চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই) ২০২২ সালে একটি গবেষণার পর যে তিনটি খাতে বিনিয়োগের জন্য অবারিত সুযোগ আছে বলে চিহ্নিত করেছিল, তার মধ্যে অন্যতম কৃষিখাত। এ প্রসঙ্গে এফআইসিসিআইয়ের নির্বাহী পরিচালক টিআইএম নুরুল কবির বলেন, আমরা যে গবেষণা করেছিলাম, সেখানে দেখা গেছে, কৃষি, ডিজিটাল ইকোনমি আর গ্রিন ফাইন্যান্স- এই তিনটা খাতে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগের সুযোগ রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ নিয়ে বিশ্বের অনেক বড় বড় কোম্পানি বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে। কৃষি নির্ভর দেশ হওয়ায় এই খাতকে ব্যবহারের বিশেষ সুযোগ রয়েছে। কারণ অনেক দেশই তাদের প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য অন্য দেশ থেকে আমদানি করে। এখানে যদি সেই চাহিদাকে অ্যাড্রেস করা যায়; তাহলে এটিও রপ্তানির জন্য বিশাল খাত হয়ে উঠতে পারে।
সেজন্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে এই খাতের সম্ভাবনা তুলে ধরতে হবে।