" />
বগুড়া প্রতিনিধি:
বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও ধুনট উপজেলায় যমুনা নাব্যতা সংকটে পড়েছে। এক সময়ের প্রমত্তা নদী নাব্যতা সংকটে পড়ায় নদীর দু’পাড়ের মানুষগুলো নদী পারাপারে চরম দুর্ভোগে পড়েছে। এতে ধুনটের সহরাবাড়ি নৌ-ঘাট থেকে অভ্যন্তরীণ রুটে নৌযান চলাচল বন্ধের উপক্রম হয়েছে। ফলে পণ্য ও যাত্রী পারাপারে বেকায়দায় পড়েছেন মানুষ। ঘাটে পানি কমে যাওয়া এবং নদীতে চর জেগে উঠায় কয়েক কিলোমিটার পায়ে হেঁটে গিয়ে নদী পার হতে হচ্ছে। শহরাবাড়ি নৌ-ঘাট থেকে জামালপুর ও সিরাজগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকার সঙ্গে পারাপার চলে বলে নৌ-ঘাট সংশ্লিষ্ট বিভিন্নজনেরা জানিয়েছেন।
এর মধ্যে রয়েছে যমুনার বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও জামালপুর জেলার প্রায় ৩৫টি চরাঞ্চল। যমুনার দুই পাড়ের মানুষের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম নৌপথ। প্রতিদিন হাজারো যাত্রী জেলা শহরে যাতায়াত করে থাকেন। কিন্তু দীর্ঘদিন যমুনা নদী খনন না করায় এবং নদীর দুই তীর ভাঙনের ফলে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে।
যমুনা নদীর পানি কমে নাব্য সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। যমুনা নদীর নাব্য সংকটে এই নৌরুটে অসংখ্য ডুবোচর সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এই নৌপথে নৌকাগুলো ডুবোচরে আটকে যাচ্ছে। মাঝিরা নদীতে নেমে অনেক কষ্টে যাত্রীসহ নৌকাগুলো ঠেলে ডুবোচর থেকে নামাচ্ছেন। নিরুপায় হয়ে সারিয়াকান্দি পৌরসভার কালীতলা নৌঘাট দুই কিলোমিটার দূরে দেলুয়াবাড়ী গ্রামে স্থানান্তর করা হয়েছে।
এছাড়াও নদীর বুকে জেগে উঠেছে ছোট ছোট ডুবোচর। এতে নৌ চলাচলে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। নদীর পূর্ব পাশ থেকে যমুনা ফার্টিলাইজারের সার সহজে এবং কম খরচে বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় পরিবহন হয় এই দুটি ঘাট দিয়ে। জেলা পরিষদ থেকে বার্ষিক ইজারা নিয়ে ইজারাদাররা নৌকায় লোকজন পারাপার করেন। উপজেলার একাধিক সার ডিলার বলেন, যমুনা সার কারখানার বরাদ্দের সার আমরা নদীপথেই নিয়ে আসি। কারণ এতে খরচ ও সময় দুটিই কম হয়।
জানা যায়, ১৯৯৮ সালের পর থেকে যমুনার উজানে নদী ভরাট হয়ে চর জাগতে শুরু করে। এখন বঙ্গবন্ধু সেতুর উজানে সিরাজগঞ্জ থেকে কুড়িগ্র্রাম পর্যন্ত ২৩০ কি.মি. নদীতে ছোট বড় চরের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার। নতুন আরো এক হাজার চর জেগে ওঠার অপেক্ষায় আছে। এক সময়ের প্রমত্তা যমুনা নদী এখন নাব্যতা হারিয়ে বিভিন্ন রুটে নৌ চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। যমুনার বুকে এখন ধূ ধূ বালু চর। মাইলের পর মাইল হেঁটে চরে বসবাসরত মানুষকে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করতে হচ্ছে। যমুনা চড়ে শিক্ষার আলো, স্বাস্থ্য সেবা, সড়ক সেবাসহ প্রায় সব ধরনের নাগরিক সেবা বঞ্চিত বরাবরই এই মানুষগুলো। বালুর মধ্যেই চাষাবাদ এবং গরু-ছাগল পালন এদের প্রধান পেশা। এখন অবশ্যই অনেক চরে মরিচ, আলু, বাদাম, গম, ভুট্টাসহ প্রায় সব রকমের ফসলের চাষ হয়। তার পরেও এই চারের কৃষিকরা বঞ্চিত কৃষি সেবা থেকেও। এসব বালুচরের কারণে বর্ষা মৌসুমেও নৌকা চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ভারতেই যমুনা নদীর মূল উৎপত্তি। উৎপত্তিস্থল থেকে যখন পানি বাংলাদেশে প্রবেশ করে তখন এর গতি থাকে অনেক। পানির গতির কারণে ভরতের অংশের মাটি বছরে প্রায় ২ বিলিয়ন টন বাংলাদেশ অংশের নদীতে পরে। এর ফলে ক্রমান্বয়ে নদী ভরাট হতে থাকে। নদীর গভীরতা কমে বর্ষা মৌসুমে অল্প পানিতেই বন্যার সৃষ্টি হয়।
কথিত রয়েছে, ১৯৫৮ সাল থেকে যমুনায় নদী ভাঙন শুরু হয়। ১৯৭৭ সালের পর এই ভাঙন ভয়াবহ রূপ নেয়। ফলে বিভিন্ন সময়ে ডান তীরের ১০৫ টির বেশি গ্রাম নদীভাঙনের শিকার হয়ে সম্পূর্ণভাবে যমুনাগর্ভে বিলিন হয়ে যায়। ফলে এইসব অঞ্চলের উপর দিয়ে যমুনা নদী তার প্রবল স্রোতধারা নিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। তখন নদীর ডানতীর ঘেঁসে গতিপথের অবস্থান হয়।
১৯৭৭ সালে শুরু হয় নদী শাসনের কাজ। ১৯৮৬ সালে জেলার সারিয়াকান্দির প্রধান পয়েন্টে কালিতলায় একটি গ্রোয়েনবাঁধ নির্মিত হয়। ধুনট সীমানা থেকে সারিয়াকান্দির হাটশেরপুর ইউনিয়নের হাসনাপাড়া বাজার পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে যমুনা নদীর ডানতীর সংরক্ষণের কাজ করা হয়। কালিতলা গ্রোয়েনবাঁধ থেকে পারতিত পরল পর্যন্ত ২ হাজার মিটার এবং দেবডাঙা পয়েন্টে ১২’শ মিটার, পারতিত পরল থেকে হাসনাপাড়া পর্যন্ত তীর সংরক্ষণ কাজ হয়। এছাড়া রৌহাদহ থেকে মথুরাপাড়া পর্যন্ত ৬ কি. মি. তীর সংরক্ষণ কাজ হয় এ পর্যন্ত। ফলে উজান থেকে বয়ে আসা পলিজমে উপজেলার চালুয়াবাড়ী, হাটশেরপুর, কাজলা, কর্নিবাড়ী এবং সারিয়াকান্দি সদরের মৌজায় বিশালাকার আয়তনের চরাভূমির সৃষ্টি হয়েছে।
স্থানীয়দের মতে, নদী শাসনের কাজগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য যমুনা নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে এখন বাম তীর ঘেঁসে জামালপুরের সিমানার কাছাকাছি অবস্থান করছে।
এদিকে যমুনা নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে সারিয়াকান্দি উপজেলার চারটি ইউনিয়নের মৌজার জমিগুলো পুনরায় জেগে উঠেছে। এসব জমিগুলোতে নানা ধরনের কৃষি ফসল উৎপাদিত হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে এসব অঞ্চলগুলো হতে নদীভাঙনের শিকার হয়ে অন্যত্র চলে যাওয়া জনসাধারণ আবার পুনরায় নতুন করে এখানে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখছেন।
স্থানীয় চরবাসীরা জানায়, আগে এ যমুনা নদীর পথে নিয়মিত দেশের বিভিন্ন বন্দর থেকে তেল সারসহ বিভিন্ন পণ্য নিয়ে জাহাজ চলাচল করায় এটা জাহাজ গড়ান নদী হিসাবে সবার কাছে পরিচিত রয়েছে। নদীর গভীরতা হারিয়ে যাওয়ায় আর কোন জাহাজ কার্গো উত্তর দিকে যাতায়াত করছে না। এখন নদীর এমন অবস্থা জাহাজ তো দূরের কথা পণ্য বোঝাই নৌকা নিয়ে হাটে ঘাটে যাওয়াই কঠিন।
নৌকার মাঝিরা জানান, নদীর নাব্যতা সংকট ও ডুবোচরে নৌকা লেগে যাওয়ায় বাড়তি সময় লাগছে। এতে নদীতে নৌ চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। প্রায় ৩ মাস এই অবস্থায় চলছে। কিন্তুএ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়নি সংশ্লিষ্ট দপ্তর ।
সহরাবাড়ি নৌকাঘাটের ইজারাদার হজতর আলী বলেন, প্রায় ২০ লাখ টাকায় এক বছরের জন্য ইজারা নিয়েছি। ঘাট এলাকায় নদীর পানি কমে যাওয়া এবং চর জেগে উঠায় অনেক পথ ঘুরে বেশি সময়ে যাত্রী পারাপার করতে হচ্ছে। প্রায় অচল হওয়ার পথে নৌকাঘাট। এতে ইজারার টাকা উঠবে কিনা সন্দেহ। তাই দ্রুত ঘাট সংস্কার ও নদী খনন করে নৌযান চলাচলের উপযোগী করার দাবি জানাচ্ছি।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানান, বগুড়ায় যমুনা নদী খনন করে ৫ কিলোমিটারের মধ্যে এর নাব্যতা ধরে রাখা হবে। বাকি অংশের জমি উদ্ধার করে বসতবাড়ি, কৃষি ফসল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করা হবে। এজন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড কাজ করছে। শিগগিরই এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। বর্তমানে শুকনো মৌসুমে যমুনার বুকে অসংখ্য চর ভূমি জেগে ওঠায় নদীগুলো অসংখ্য শাখা প্রশাখায় পরিণত হয়েছে। জেগে উঠেছে এ অঞ্চলে হাজারও বালুচর। ফলে স্বাভাবিক সময় নৌ-রুটে যত সহজ যোগাযোগের পথ হয় শুকনো মৌসুমে নাব্যতা হারানোর ফলে ঘুরে যাতায়াত করতে হয় নৌকাগুলোকে বলে ওই কর্মকর্তা দাবী করেন।
এনডিটিভি,এসইই