" /> অন্তুর শৈশব – শিখা ইসলাম - নাগরিক দৃষ্টি টেলিভিশন
বুধবার, ২২ মার্চ ২০২৩, ০১:১৯ অপরাহ্ন

অন্তুর শৈশব

Ndtv Overlay1

5 / 100

তখন শান্ত দুপুর। এরকম রোদ ছড়ানো নিপাট দুপুরে অন্তু তার নানাবাড়ির খুব কাছের দীঘির পাড়ে এসে বসে, একা একদম একা। 

তার মা চলে গেছে পাঁচ বছর আগে না ফেরার দেশে।  এখন অন্তর বয়স দশ কি বারো বছর।  অন্তু বাবার সাথে শহরেই থাকে।  কখনো আবার স্কুল ছুটি হলে চলে আসে নানা বাড়ি। শহর সংলগ্ন নানা বাড়ীর গ্রাম।  আধাশহর আধা গ্রাম ওর ভালই লাগে। এখানে এসে একা হলেই কান্না পায় শুধু মায়ের জন্য।  মা থাকতে সে তো এখানেই থাকতো।  বাবা চলে চলে আসতো শহর থেকে।

মাকে বলতো চলো শহরে বাসা ভাড়া করে থাকি।  মা বলতো- আগে  খোকা বড় হোক, ওকে স্কুলে দেওয়ার সময় হলেই শহরে গিয়ে থাকবো। মার কথাই ঠিক হলো, শহরে গিয়ে থাকা ঠিকই হল তবে মা ছাড়া। 

যখন মা ছিল, তখন মা প্রায়শই অন্তুর প্রিয় দীঘিটার পাড়ে এসে বসতো, খালামনিও থাকতো তখন। অন্তু মজা করে দীঘির মাছেদের কিলবিল দেখতো। কখনও দীঘিটা থাকতো একদম শান্ত। তখন আকাশ দেখা যেত দীঘির জলে, মনে হত সাদা মেঘগুলো যেন আকাশে নয়, দীঘির জলেই ভেসে বেড়াচ্ছে। লোকেরা ছিপ দিয়ে দীঘিতে মাছ ধরতো। কখনো নিরিবিলি দুপুরে নিস্তব্ধ জলে খালামণি দীঘির জলে অন্তুরছায়া আয়নার মত করে দেখাতো।  এটি অন্তুর কাছে একটা মজার খেলা হয়ে উঠেছিল। কোনদিন আবার অন্তু  একা একা বাড়ি থেকে বের হয়ে চুপিচুপি চলে আসতো এই জলের ধারে।  বর্ষায় দীঘি কানায় কানায় ভরে যেত। হঠাৎ এক-দুটো মাছ শূন্যে লাফিয়ে আবার পানিতে ডুবে যেত। অন্তুর মনে তখন এক ধরনের শিহরণ খেলে যেত।

অন্তুর বয়স ছয় বছর হলে বাবা একরকম জোরাজুরি করে ওকে শহরে নিয়ে গেল।  তারপর স্কুলে ভর্তি। আটসাট ছোট্ট বাসা। শহর অন্তুর ভালো লাগে না, বায়না করে মাকে নিয়ে মাঝেমাঝে নানাবাড়ি চলে আসতো।  শীতে কত পাখি এসে  দীঘিটায় বসতো, নাম না জানা সেসব পাখি।  অন্তুর ছোট্ট মনের ভাবনায় কুলায় না অন্য সময় এরা থাকে কোথায়? 

অজানা রোগে অন্তুর মা চলে যায়। বাবার সাথে শহরে ফিরলে ছোট্ট বুকে জমাট কষ্টগুলো যেন উছলে উঠে। কিছুদিন পর খালামনির বিয়েতে ওরা আবার গ্রামে এলো। অন্তু বেশ কিছুদিন পর দীঘিটার পাড়ে গেল ।  পানিতে তাকিয়ে মার মুখটি দেখার চেষ্টা করল, একি! পানির রং এমন কেন! গোলাপি গোলাপি কোথাও বা কালচে।  মাছগুলো আর কিলবিল করছে না।  খালামণি পাশে এসে দাঁড়ালো।  অন্তুর প্রশ্নাতুর দৃষ্টি পানিতে।  খালামণি বুঝতে পারে। বলে- অন্তু, দিঘির জল আর আগের মত নাইরে।  ডাইং মেশিনের পানি নালা দিয়ে এসে মাছগুলোকে মেরে ফেলেছে। 

খালামনির বিয়ে শেষ।  আবার শহর আবার একলা থাকাথাকি।  অন্তু ওর মার মৃত্যুর পর স্বভাবে একদম চুপচাপ হয়ে গেছে।  খালামনির বিয়ের পর আরো শান্ত হয়ে যায়।  বার্ষিক পরীক্ষা শেষ, প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে এবার হাইস্কুলে যাবে সে। বাবা ওকে নানাবাড়ি নিয়ে যায়।  বাড়িতে ঢোকার আগেই অন্তু দৌড়ে দীঘিটার পাড়ে যায়, দেখতে চায় মায়ের ছায়ামুখ ।  কিন্তু হায়! একি! একটা পাশ ব্লক হয়ে গেছে।  আরেক পাশে বালি উঠানো হচ্ছে।  চারদিকে আগে থেকেই দালান কোটা উঠছিল, এবার দীঘিটা ভরাট করে উঠেছে বিশাল হাউজিং স্টেট এর সাইনবোর্ড।  ছোট মামা এসে অন্তুকে জোর করে বাড়িতে নিয়ে যেতে চায়, বলে এখানে এখন ডেভেলোপাররা কাজ করছে।  আমাদের বাড়িটা ওদের দিয়ে দেবো তাহলে আমরাও ফ্ল্যাটে থাকতে পারবো।  আমাদের বাড়িটাও শহরের বাড়ি হয়ে যাবে। অন্তু বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে ওদিকে তখন দীঘির বুকে শুধু বালি ফেলা হচ্ছে।  যেমন করে অন্তুর মায়ের কবরে তারা মাটি দিয়েছিল। 

অন্তু মায়ের মুখটা দীঘির জলে আবারও দেখার স্বপ্ন দেখে।

লেখকঃ শিখা ইসলাম


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


ফেসবুকে আমরা