" />
যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে বেলুন ওড়ানো নিয়ে চীনের বারবার অবস্থান পরিবর্তনের সর্বশেষ নজিরটি হলো তাদের পক্ষ থেকে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই চীনের আকাশে বেলুন উড়ানোর অভিযোগ।
প্রায় দুই সপ্তাহ আগে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবার চীনের বিরুদ্ধে তাদের ভূখণ্ডে একটি গুপ্তচর বেলুন উড়ানোর অভিযোগ এনেছিল।
এই ঘটনা চীন সরকার এবং জনগণের মধ্যে ক্ষোভ এবং উত্তেজনাপূর্ণ জল্পনা- দুটোরই জন্ম দিয়েছে।
নীরবতা, তারপর স্বীকারোক্তি
২ ফেব্রুয়ারি পেন্টাগন প্রথম বেলুনের অস্তিত্ব ঘোষণা করার পর, চীনা কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেয়া থেকে বিরত থাকেন। তবে পরের দিন সন্ধ্যায় তারা নীরবতা ভাঙেন।
এক বিবৃতিতে তারা স্বীকার করেন যে বস্তুটি তাদের ছিল। কিন্তু তারা আরো বলেন যে এটি একটি ‘বেসামরিক আকাশযান যা গবেষণার জন্য বিশেষ করে আবহাওয়া সংক্রান্ত বিষয়ে ব্যবহৃত হয়।’ যেটি বাতাসের কারণে ভুল পথে উড়ে গেছে।
বেইজিংয়ের জন্য বিরল হলেও অনেকটা ক্ষমাপ্রার্থনার সুরে চীন বলে, তারা এটিকে একটি দুর্ঘটনা হিসাবে চিহ্নিত করেছে। তারা বলেছে, ‘তাদের ক্ষমতাবহির্ভূত কারণে আকাশযানটি মার্কিন আকাশে ঢুকে পড়ায় তারা দুঃখিত।’
কিন্তু সরকারের স্বীকারোক্তির আগ পর্যন্ত চুপ করে থাকা রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম আরো রক্ষণাত্মক হয়ে উঠে।
চায়না ডেইলি দাবি করে, ‘বেলুন নিয়ে বানোয়াট মিথ্যাকে চীনের সাথে যুক্ত করা যাবে না,’ অন্যদিকে গ্লোবাল টাইমস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘চীনের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক পদক্ষেপ না নিয়ে বরং দেশটির সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের উপর বেশি আন্তরিক হওয়ার আহ্বান জানায়।’
নেটিজেনরা ঘটনাটি নিয়ে রসিকতা করতে এক মুহূর্ত দেরি করেনি। অনেকে বস্তুটিকে ‘দ্য ওয়ান্ডারিং বেলুন’ বা ‘ভবঘুরে বেলুন’ বলে ডাকতে শুরু করেছে। চীনের একটি জনপ্রিয় বৈজ্ঞানিক-কল্পকাহিনী এবং চলচ্চিত্র ‘দ্য ওয়ান্ডারিং আর্থ’ এর সাথে মিল রেখে এমনটা বলছে তারা।
পরদিন সকালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন চীনে একটি পরিকল্পিত সফর বাতিল করার পর চীনা কর্তৃপক্ষ একটি দীর্ঘ এবং আরো জোরালো রক্ষণাত্মক বক্তব্য প্রকাশ করে। তারা দাবি করে যে ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রাজনীতিবিদ এবং মিডিয়া চীনকে আক্রমণ ও তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করতে বিষয়টিকে ভুলভাবে উপস্থাপন করছে।’
সেই দিনই, যুক্তরাষ্ট্র বেলুনটি গুলি করে ভূপাতিত করে যা চীনকে ক্ষুব্ধ করে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং এটিকে একটি ‘স্পষ্ট মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া’ এবং ‘অগ্রহণযোগ্য এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন’ বলে অভিহিত করেন।
বেলুনের অবশিষ্টাংশ ফেরত দেয়ার জন্য চীন অনুরোধ করেছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আকাশযানটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নয়। এটি চীনের।’
বেইজিংয়ে থাকা মার্কিন দূতাবাসে এ বিষয়ে একটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দিয়েছে চীন।
চীনা জাতীয়তাবাদীরা ক্ষুব্ধভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিন্দা করেছে।
বিশিষ্ট ভাষ্যকার এবং গ্লোবাল টাইমসের সাবেক প্রধান সম্পাদক হু শিজিন বলেন, তিনি মনে করেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে এই ‘পরিস্থিতির অবসান করতে হয়েছে’ কারণ আমেরিকানরা ‘দুর্ঘটনার পেছনে সত্য অনুসন্ধান করার পরিবর্তে এর রাজনীতিকীকরণ করতে চেয়েছিল’।
এরইমধ্যে, দ্বিতীয় আরেকটি বেলুন লাতিন আমেরিকার উপর দিয়ে ভেসে যেতে দেখা গেছে, যা চীনা কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে যে সেটিও তাদের ছিল।
ঘনীভূত জল্পনা
চীনা ইন্টারনেটে বেলুনটি নিয়ে রীতিমতো জল্পনা শুরু হয়েছে যে ঠিক কে বা কারা বেলুনটি উড়িয়েছে তা নিয়ে। কারণ বেলুনটি বেসামরিক কোনো উৎস থেকে উড়ানোর বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারেনি তারা।
অনেকে সাম্প্রতিক বিভিন্ন আর্টিকেল দেখে কেমচায়না ঝুঝও রাবার রিসার্চ এন্ড ডিজাইন ইন্সটিটিউট নামে স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করছে যারা এ ধরণের উচ্চতায় উড়তে সক্ষম বেলুন উৎপাদন করে।
কিছু ব্লগার দাবি করেছেন যে একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সহযোগী প্রতিষ্ঠান কেমচায়না ঝুঝও বেলুনটি তৈরি করেছে। কিন্তু এটির সাথে কোম্পানির সংযোগের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
রোববার এই বিভ্রান্তি আরো জোরালো হয় যখন পূর্ব শানদং প্রদেশের উপকূলে একটি অজ্ঞাত বস্তু উড়ে যাওয়ার বিষয়ে দ্য পেপার নামে একটি সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এই প্রতিবেদনে বলা হয়, মৎস্য কর্মকর্তারা স্থানীয় জেলেদের সতর্ক করে বলেছে যে চীনা কর্তৃপক্ষ বস্তুটিকে গুলি করে নামানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
প্রতিবেদনটি চীনের কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমও প্রকাশ করে তবে রাষ্ট্রীয় মিডিয়া এবং সরকারি বিভাগগুলো এ নিয়ে মুখ খোলেনি। তবে এটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। কিছু অ্যাকাউন্ট থেকে স্যাটেলাইটের চিত্রসহ লাইভ স্ট্রিমিং করা হয়েছে।
কিন্তু কিছু অনলাইন বিষয়টিকে সন্দেহের চোখে দেখেছে এবং প্রশ্ন তুলেছে যে এই সংবাদটি কেন আরো আনুষ্ঠানিক মাধ্যমে ঘোষণা করা হলো না।
পাল্টা ব্যাখ্যা
সোমবার চীন সরকারের একটি নতুন অভিযোগ তুলেছে যে গত বছরে মার্কিন বেলুন কমপক্ষে ১০ বার তাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘মার্কিন পক্ষের উচিত ছিল প্রথমে নিজেদের কলঙ্কমুক্ত হওয়া। চীনকে কলঙ্কিত এবং দোষারোপ করার পরিবর্তে নিজেদের আত্ম-প্রতিফলন করা উচিত ছিল।’
যুক্তরাষ্ট্র এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
একই সাথে, রাষ্ট্রীয় মিডিয়া একটি ভিন্ন বিষয়কে সামনে এনেছে। তারা বলছে যে যুক্তরাষ্ট্রের ওহায়োতে বিপজ্জনক উপাদান বহনকারী একটি লাইনচ্যুত ট্রেন রয়েছে।
যদিও ঘটনাটি ফেব্রুয়ারির শুরুতে ঘটেছিল, তারপরও মার্কিন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে চীনা সংবাদ মাধ্যমগুলো এখন এ বিষয়টি উল্লেখযোগ্যভাবে প্রচার করছে। মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছে যে তারা দূষণরোধ করতে ট্রেন থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক নিয়ন্ত্রিতভাবে বের করেছে।
এরপর থেকে এটি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। ওয়েইবো যা চীনে টুইটারের মতো, সেখানে ওহায়োর ট্রেন হ্যাশট্যাগটি সপ্তাহান্তে ৬৯ কোটির বেশি বার দেখা হয়েছে, এই বিষয়ে ৪০টিরও বেশি হ্যাশট্যাগ তৈরি করা হয়েছে।
অনেক চীনা নেটিজেন উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে ঘটনাটি একটি বৈশ্বিক পরিবেশগত সঙ্কটে পরিণত হবে এবং বেলুনের তুলনায় মার্কিন মিডিয়াতে ট্রেনের ঘটনার তুলনামূলকভাবে কম প্রতিবেদন করা হয়েছে।
‘ওহায়োর বিষয়ে উত্তেজনা কমাতেই মনে হচ্ছে দিশাহীনভাবে ঘুরতে থাকা বেলুনকে ব্যবহার করা হয়েছে,’ লেখা পোস্টটি প্রায় তিন হাজার বার পড়া হয়েছে।
সূত্র : বিবিসি