" />
চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনকে ট্যাংক দিয়ে সাহায্য করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও যুক্তরাজ্য। অবশ্য ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ন্যাটো জোটের কাছে শুধু ট্যাংক নয়, যুদ্ধবিমানও চাইছেন। তবে এখনো কোনো দেশই তা দেবার স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দেয়নি।
এ্যাব্রামস বা লেপার্ডের মত ট্যাংক ও এফ-সিক্সটিনের মতো যুদ্ধবিমান দেয়া হলে তা ইউক্রেনের সামরিক সক্ষমতা অনেকখানি বাড়িয়ে দেবে।
অনেক বিশ্লেষকই মনে করছেন, এসব সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন রাশিয়ার বিরুদ্ধে রণক্ষেত্রে ইউক্রেনকে সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে যাবে, পশ্চিমা বিশ্ব বা ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলোকেও এ যুদ্ধে আরো গভীরভাবে জড়িয়ে ফেলবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, তার পরিণাম কী হতে পারে?
এর ফলে কি চলমান এই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আরো ব্যাপক ও বিপজ্জনক মাত্রা পেয়ে যেতে পারে?
“বসন্তের শুরুতে নতুন রুশ অভিযান”
ইউক্রেনে এখন চলছে শীতকাল। মাটি বরফে ঢাকা, স্যাঁতসেঁতে নরম, যা ট্যাংকের মত ভারী সামরিক যান চলার উপযোগী নয়।
কিন্তু মার্চ মাস থেকে ইউরোপে বসন্তকালের শুরু। তখন আবহাওয়া পাল্টাতে শুরু করবে। ওই সময়ই রাশিয়া নতুন উদ্যমে তাদের ‘স্প্রিং অফেন্সিভ’ শুরু করবে- এমনটাই ধারণা করা হচ্ছে।
সমর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২৩ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে এটাই হবে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
রাশিয়া ইতোমধ্যেই তাদের নতুন নিয়োগ করা ৫০ হাজার সৈন্যকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়েছে। আরো প্রায় আড়াই লাখ সৈন্যকে প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধের জন্য তৈরি করার কাজ শেষ করে এনেছে।
তাদের এ অভিযান ঠেকাতে ইউক্রেনের দরকার উন্নতমানের ট্যাংক।
শুধু ট্যাংক নয়, দরকার হবে কামান ও গোলাবারুদ, সেনা বহনকারী সাঁজোয়া যান ও যুদ্ধ বিমান- যা আকাশ থেকে ট্যাংক বহরের অগ্রযাত্রাকে সুরক্ষা দেবে।
ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক বিজ্ঞানী ও বিশ্লেষক আন্দ্রেই পিওন্তকোভস্কি বিবিসিকে বলেছেন, “এ যুদ্ধে ইউক্রেনের বিজয় নির্ভর করবে কত দ্রুতগতিতে ন্যাটো ট্যাংক, বিমান ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পাঠাতে পারে, তার ওপর।“
যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাংক এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?
আধুনিক স্থলযুদ্ধে ট্যাংক এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কারণ, এটা শত্রুপক্ষের অবস্থান বা রক্ষণব্যূহ ভেদ করে সামনে এগুতে ও জায়গা পুনর্দখল করতে বড় ভূমিকা রাখে।
ট্যাংক চলার জন্য রাস্তা দরকার নেই। অসমান, উঁচু-নিচু, খানাখন্দে ভরা মাটির ওপর দিয়েও তা চলতে পারে। একইসাথে ট্যাংক হচ্ছে এক চলন্ত কামান, যা যুদ্ধরত বাহিনীকে শত্রুর প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেঙে সামনে এগুনোর ও গোলাবর্ষণের ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
সমর-বিশেষজ্ঞ ও কুয়ালালামপুরের মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মাহমুদ আলি বলছেন, “ট্যাংক হচ্ছে সাঁজোয়া যান। এর গায়ে বর্ম থাকে। তা ভেদ করতে হলে বিশেষ ধরনের অস্ত্র দরকার, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সবার কাছে তা থাকেও না।”
‘ট্যাংকের প্রধান যে কামান তা ১২৫ মিলিমিটার ক্যালিবার পর্যন্ত হতে পারে। এটা দিয়ে শত্রুপক্ষের ট্যাংক, সৈন্য, যানবাহন, দালানকোঠা ও বাংকার ধ্বংস করা যায়। আর এটা যেহেতু সচল অস্ত্র, তাই বেশ কিছু ট্যাংকের বহর যখন একদিকে অভিযান শুরু করে, তখন তা ঠেকানো বেশ কঠিন।
যুদ্ধবিমান ছাড়া ট্যাংক কতটা কার্যকর?
সৈয়দ মাহমুদ আলি বলেন, ট্যাংক একাই কোনো যুদ্ধ জেতার জন্য যথেষ্ট নয়। তার সাথে দরকার ভারী কামানের গোলাবর্ষণ, যা শত্রুর প্রতিরক্ষা ব্যূহকে দুর্বল করতে পারে। তাছাড়া পুনর্দখল করা জায়গা নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাদের পদাতিক বাহিনীর সাহায্যও দরকার। একইসাথে ট্যাংক বহরের মাথার ওপর যুদ্ধ বিমানের সুরক্ষাও দরকার- আকাশপথে আক্রমণ ঠেকানোর জন্য।
“ট্যাংক বহরকে বিমান বহর আকাশে সুরক্ষা না দেয়া পর্যন্ত ট্যাংকগুলো বিপদের মুখে থাকবে। যুদ্ধের প্রথম দিকে রুশদের ঠিক এ কারণেই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।”
“ইউক্রেনের বিমান বহর খুব একটা শক্তিশালী নয়। এগুলো দিয়ে পশ্চিমা ট্যাংক বহরকে কতটা কার্যকরী রাখা যাবে, তা বলা কঠিন। সে কারণেই ইউক্রেন আমেরিকান এফ সিক্সটিন ও সুইডেনের গ্রিপেনের মতো অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান চেয়েছে।”
রাশিয়া-ইউক্রেন সম্মুখ যুদ্ধ চলছে এক হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এক বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে।
ইউক্রেনের কর্মকর্তারা বলছেন, আগামী কিছু দিনের মধ্যেই রাশিয়া দোনেৎস্ক, লুহানস্ক ও জাপোরিশা লক্ষ্য করে এক নতুন আক্রমণ শুরু করবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
ইউক্রেন চাইছে সেটাকে প্রতিহত করতে। কিন্তু তারা পশ্চিমা ট্যাংক পাওয়ার আগেও এ আক্রমণ শুরু হয়ে যেতে পারে।
ইউক্রেনের আরো একটা লক্ষ্য হচ্ছে, নিজেদের হারানো ভূমি পুনরুদ্ধার করা।
এ দু’টি উদ্দেশ্য সফল করতে হলে তাদের ট্যাংক দরকার। কিন্তু ইউক্রেনের কাছে যেসব ট্যাংক আছে, তা সোভিয়েত-যুগের ও পুরনো।
সৈয়দ মাহমুদ আলি বলছিলেন, ইউক্রেনের আশঙ্কা, আগামী দু-এক মাসের মধ্যেই তাপমাত্রা যখন আরেকটু ওপরে উঠবে, বরফ গলে যাবে, মাটি শক্ত হবে, তখন রাশিয়া নতুন করে অভিযান শুরু করবে। তা প্রতিহত করার জন্য এবং ইউক্রেনের পূর্ব দিকে ডনবাস আর দক্ষিণের যেসব জায়গা রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, সেগুলো পুনর্দখল করার জন্য যত দ্রুত সম্ভব পাশ্চাত্যের আধুনিক ট্যাংক দিয়ে আক্রমণ চালাতে চাইছে ইউক্রেন।
কী ধরনের ট্যাংক পাচ্ছে ইউক্রেন
ইউক্রেন ন্যাটোর কাছে অন্তত ৩০০ ট্যাংক চেয়েছে। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত জার্মানি ১৪টি লেপার্ড-টু ট্যাংক, আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৩০টি এম-ওয়ান আব্রামস ট্যাংক দেয়ার কথা বলেছে। তাছাড়া যুক্তরাজ্য দিচ্ছে চ্যালেঞ্জার ট্যাংক। পোল্যান্ডও ইউক্রেনকে ট্যাংক পাঠানোর কথা ঘোষণা করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির সিদ্ধান্তের পর হয়তো আরো কিছু দেশ যেমন ফ্রান্সও কিছু ট্যাংক দেবে বলে জানা যাচ্ছে।
এর সাথে ইউক্রেন আরো পাবে ব্রিটেনের তৈরি কামান, মাইনরোধী যান, সেতু-নির্মাণের যান এবং ব্রিটিশ, মার্কিন ও জার্মান সাঁজোয়া যান।
ফলে অনেক বিশ্লেষকই বলেছেন, এটি এক ‘গেমচেঞ্জার’ ঘোষণা।
কিন্তু এটার ফলে ইউক্রেন প্রকৃতপক্ষ কতটা সুবিধা পাবে? এই শ’ তিনেক ট্যাংক কি ইউক্রেনের যুদ্ধে জেতার জন্য যথেষ্ট হবে?
রুশবিষয়ক বিশ্লেষক স্টেফেন ডিয়েল বলছেন, “ইউক্রেন ৩০০ ট্যাংক চেয়েছিল, তবে তারা যদি শ’খানেক ট্যাংকও পায় এবং এর সাথে সাঁজোয়া যান, আর্টিলারি, বিমানবিধ্বংসী কামান, অর্থাৎ একটা যথাযথ ফরমেশনে যা যা থাকতে হয়, সেগুলো ঠিকমত থাকলে- ইউক্রেন এ যুদ্ধে বিরাট সুবিধা পেয়ে যাবে।”
তারা হয়তো পূর্ব ইউক্রেনের দখল হয়ে যাওয়া এলাকা থেকে রুশ বাহিনীকে হঠিয়ে দিতেও সক্ষম হতে পারে।
সৈয়দ মাহমুদ আলি বলছেন, “ইউক্রেন ভাবছে, পূর্বদিকের ডনবাস অঞ্চলে যেখানে নদী-নালা কম, মজবুত সেতু আছে- যেখানে বরফ গলে যাবার পর মাটি শক্ত ও শুকনো হয়, যেখানে ৭০-৮০ টন ওজনের ট্যাংক চলতে পারবে, সেখানে ট্যাংক ব্যবহার করা যাবে। কারণ, যুদ্ধে তাদের একটা লক্ষ্য হচ্ছে, হারানো এলাকাগুলো পুনরুদ্ধার। এজন্য তারা চাইছে, যাকে বলা হয় কনসেন্ট্রেশন অব ফায়ার- একই জায়গায় অনেক ট্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ গোলাবর্ষণ করে শত্রুর ব্যুহ ভেঙে দেয়া। এ ধরনের একটা চিন্তা তাদের রয়েছে।“
কথা হচ্ছে, ট্যাংক তো রাশিয়ারও আছে। তারা কি ইউক্রেনের এসব ট্যাংক মোকাবিলা করতে পারবে না?
বিশ্লেষকরা বলছেন, রুশ সশস্ত্র বাহিনীর হাতে হাজার হাজার ট্যাংক থাকলেও ন্যাটো জোটের কাছ থেকে ইউক্রেন যেসব ট্যাংক পাবে- তা বেশি দ্রুতগামী ও উন্নত।
বিশ্লেষক স্টিফেন ডিয়েল বলছেন, এটা ঠিক যে কোনো ট্যাংকই পুরোপুরি দুর্ভেদ্য নয়। তবে রাশিয়ার সবচেয়ে আধুনিক ট্যাংক টি-১৪-এর চেয়েও ন্যাটো জোটের ট্যাংকগুলো উন্নত।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, অন্য সব ট্যাংকের মতো এগুলোও আগুনে পুড়বে।
তার কথায়- ইউক্রেনকে ন্যাটোর ট্যাংক দেয়াটা এক “ব্যর্থ পরিকল্পনা”। এতে কিয়েভের বাহিনী যতটুকু সুবিধা পাবে, তা “বাড়িয়ে বলা হচ্ছে।“
কিন্তু বিশ্লেষক স্টিফেন ডিয়েল বলছেন, ইউক্রেনকে পশ্চিমা দেশগুলো ট্যাংক দেবার ঘোষণার পর থেকে রুশ পক্ষে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
রুশ টিভি চ্যানেলগুলোতে ‘রাশিয়া কত শক্তিশালী’ তা তুলে ধরে যেসব প্রচারণামূলক অনুষ্ঠানগুলো হয়, সেগুলোর সুর এখন বদলে গেছে। রাশিয়া যদিও মুখে বলছে যে এসব ট্যাংক তারা ধ্বংস করে দেবে, কিন্তু আসলে তাদের মধ্যে এ নিয়ে দুশ্চিন্তা দেখা যাচ্ছে।
আরো একটা প্রশ্ন হচ্ছে, ইউক্রেন এখন পর্যন্ত ন্যাটোর কাছ থেকে শ’খানেক ট্যাংক পাবে বলে বলা হচ্ছে। যুদ্ধে কোনো প্রভাব ফেলার জন্য এই সংখ্যা কি যথেষ্ট?
ড. সৈয়দ মাহমুদ আলি বলছেন, ভবিষ্যতে ইউক্রেন আরো ট্যাংক পেতে পারে।
“ন্যাটো প্রথমে অল্প কিছু অস্ত্রের প্রতিশ্রুতি দেয়। পরে ইউক্রেন সেগুলো কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারলে তারা অস্ত্রের সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়।”
ইউক্রেন যুদ্ধে আরো গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ছে ন্যাটো?
ইউক্রেনকে ন্যাটোর ট্যাংক সরবরাহের সাথে দু’টি বিষয় জড়িত- যা এ যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ন্যাটো বনাম রাশিয়ার মধ্যে যে উত্তেজনা চলছে, তাকে আরো একধাপ বাড়িয়ে দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এর মধ্যে একটি হচ্ছে আমেরিকান এ্যাব্রামস ও জার্মানির লেপার্ড জাতীয় ট্যাংকে ব্যবহৃত বিশেষ এক ধরনের গোলা- যা দিয়ে শত্রুপক্ষের ট্যাংক ও কংক্রিটের বাংকার ধ্বংস করা যায়।
ড. আলি বলছেন, এসব গোলায় ডিপ্লিটেড বা ‘নিম্ন-মাত্রার’ ইউরেনিয়াম ব্যবহৃত হয়। তা বিস্ফোরিত হলে বাতাসে তেজষ্ক্রিয় ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে।
“রুশ কর্তৃপক্ষ বলেছে, যদি এ ধরনের গোলা তাদের এলাকায় বা তাদের সৈন্যদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়, তাহলে একে পারমাণবিক অস্ত্র-সমতুল্য বলে তারা ধরে নেবেন এবং প্রয়োজনীয় পাল্টা ব্যবস্থা নেবেন। অর্থাৎ তাহলে যুদ্ধের মাত্রা একধাপ ওপরে উঠে যাবে এবং সেটা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াতে পারে।”
আরেকটি দিক হচ্ছে, ন্যাটোর ট্যাংকের পাশাপাশি ইউক্রেনের মাটিতে পশ্চিমা প্রশিক্ষক ও সামরিক উপদেষ্টাদের সম্ভাব্য উপস্থিতি।
তবে সৈয়দ মাহমুদ আলি বলছেন, ইউক্রেনে পশ্চিমা সামরিক প্রশিক্ষক ও উপদেষ্টার উপস্থিতি ২০১৪ সাল থেকেই ছিল। উত্তর ইউক্রেনে একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্রের ওপর রাশিয়া আক্রমণও চালিয়েছিল- যাতে বেশ কিছু লোক হতাহত হয়। তবে এখন ইউক্রেনীয় বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে জার্মানি ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে।
স্টিফেন ডিয়েল বলছেন, ন্যাটোর ট্যাংক ব্যবহারের যে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে, তা হবে সম্ভবত ইউরাপের মাটিতে ।
“ইউক্রেনের সৈন্যরা সম্ভবত ইউরোপে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেবে। তবে এটা ঠিক যে কিছু পশ্চিমা পরামর্শক হয়তো ইউক্রেনের মাটিতে থাকবেন। কিন্তু এটা রাশিয়ার প্রতিক্রিয়ায় কোনো পার্থক্য তৈরি করবে না। কারণ মস্কো ইতোমধ্যেই এ যুদ্ধকে পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা ন্যাটোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলে বর্ণনা করে বসে আছে।”
ইউক্রেনের বিস্তীর্ণ অংশ এখনো রাশিয়ার দখলে
গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে রুশ অভিযান শুরুর পর থেকে ইউক্রেনকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেছে পশ্চিমা বিশ্ব।
কিন্তু এরপরও ইউক্রেনের বিস্তীর্ণ অংশ দখল করে নিয়েছে রুশ বাহিনী। সেসবের অধিকাংশের ওপর সে দখল এখনো তারা বজায় রেখেছে। এসব অংশকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়া তার নিজের অংশ বলে ঘোষণা করেছে। অনেক জায়গায় স্কুলের পাঠ্যক্রমে তা পড়ানো হচ্ছে।
সৈয়দ মাহমুদ আলি বলছেন, ইউক্রেনীয়রা রুশ বাহিনীকে অনেক ক্ষেত্রে আটকে রেখেছে। কিন্তু রুশ বাহিনী- অনেক ট্যাংক ও সৈন্য হারালেও- মনে করছে যে তারা তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হবে।
সব যুদ্ধই এক সময় আলাপ আলোচনার মাধ্যমে শেষ হয়। তবে যুদ্ধবিরতির আলোচনায় কোনো পক্ষের হাত কত শক্ত- তা নির্ভর করে যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থানের ওপর।
“ন্যাটো জোটের ট্যাংক পাবার ফলে ইউক্রেনের অবস্থান কিছুটা শক্তিশালী হবে বলে ধরে নেয়া যায়। কিন্তু বাস্তবে বিভিন্ন দেশের ট্যাংক বা জটিল সমরাস্ত্র একসাথে করে একটি অভিযানে ব্যবহার করা- তার জন্য তাদের সময় লাগতে পারে।”
তবে ড. আলি বলছেন, রুশ কর্তৃপক্ষও এখন জানে যে ইউক্রেনের হাতে কী আছে। “এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হলে তাদের কী করতে হবে, তারা তা জানে এবং সে প্রস্তুতিও তারা নেবে।”
ইউক্রেনকে ট্যাংক সরবরাহের জন্য ন্যাটোর ঘোষণার পরপরই কথা উঠেছে একইসাথে তাদেরকে এফ-১৬-এর মতো অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানও দেয়া হবে কিনা।
প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ন্যাটোর কাছ থেকে ট্যাংকের সরবরাহ পেতে না পেতেই যুদ্ধবিমানের কথা বলতে শুরু করেছেন। ব্রিটেন ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পার্লামেন্টের বক্তৃতায় জোর দিয়ে যুদ্ধবিমান দেবার আবেদন জানিয়েছেন তিনি।
সৈয়দ মাহমুদ আলির কথায়, যুদ্ধের সময় ট্যাংক বহরকে কার্যকর হতে হলে আকাশ থেকে যুদ্ধবিমানের সুরক্ষা দরকার।
তবে তিনি বলছেন, ন্যাটো এফ-১৬ বা এ জাতীয় অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান ইউক্রেনকে দিলে তা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলতে পারে।
রাশিয়া হয়তো তখন ন্যাটোর বিরুদ্ধেও কোনো পাল্টা পদক্ষেপের দিকে যেতে পারে।
তবে স্টিফেন ডিয়েল মনে করেন, ইউক্রেনকে এফ-১৬ বিমান দেয়া হলেও তা রুশ অবস্থানে কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে না।
কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, “এফ ১৬-এর মতো যুদ্ধবিমান ইউক্রেনকে দেয়া হলে, আমার ধারণা, তার সাথে এ রকম শর্তও থাকবে- যেন এগুলো শুধু ইউক্রেন থেকে রুশ সৈন্যদের তাড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।
“এসব বিমান যদি রাশিয়ার ভেতরে উড়ে গিয়ে সেখানকার কোন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত না করে- তাহলে পরিস্থিতি খুব বেশি উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠবে বলে মনে হয় না।”
স্টিফেন ডিয়েলের মতে, পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনকে সাহায্য করছে, যাতে তারা পূর্ব ইউক্রেন ও ক্রাইমিয়ার অধিকৃত এলাকা থেকে রাশিয়াকে হটিয়ে দিতে পারে।
“কিন্তু এমন কোনো অস্ত্র তারা ইউক্রেনকে দিতে চায় না, যা দিয়ে কিয়েভের বাহিনী রাশিয়ার ভেতরে ঢুকে যুদ্ধ করতে পারে।”
‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ বা ‘পারমাণবিক যুদ্ধের’ আশঙ্কা কতটা?
ইউক্রেনকে ন্যাটো ট্যাংক দিলে উত্তেজনা বেড়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যেতে পারে বা রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগ করতে পারে- এমন আশংকা প্রকাশ করেছিলেন অনেক বিশ্লেষকই।
এখন এর সাথে যুদ্ধবিমান যোগ হলে কী হতে পারে?
সৈয়দ মাহমুদ আলি বলছেন, ন্যাটো কখনোই চাইবে না রাশিয়ার সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে – যা হবে “ভয়াবহ বিপজ্জনক”। তাই সেটা এড়িয়ে যাবার জন্য দু’পক্ষই চেষ্টা করবে।
“রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি কয়েকবারই দিয়েছে। কিন্তু তেমন কিছু করেনি। ফলে পশ্চিমা নেতারা সম্ভবত একে তেমন বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করছেন না। কিন্তু এ ধরনের একটা হুমকি রয়ে গেছে।
“আমরা দেখছি যে পর্যায়ক্রমে ইউক্রেনকে দেয়া সাহায্যের পরিমাণ ও গুণগত মান বেড়ে চলেছে। এখন ইউক্রেন যদি এফ-সিক্সটিন বিমান পায় এবং ইউক্রেন যদি সেগুলো দিয়ে রুশ নিয়ন্ত্রিত বা রুশ দাবিকৃত এলাকার ওপর হামলা চালায়, তাহলে রাশিয়া হয়তো একধাপ এগিয়ে যাবে এমন আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায়না।”
স্টিফের ডিয়েলও বলছেন, পারমাণবিক যুদ্ধের চিন্তা একেবারে বাদ দেয়া যায় না। তবে রাশিয়া ন্যাটোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে এমন সম্ভাবনা গত বছরের তুলনায় কমে গেছে।
“রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি দিচ্ছে ঠিকই। কিন্তু এটা হয়তো একটা ধাপ্পা। কারণ, তারা ভালো করেই জানে যে তারা ইউক্রেনে একটি পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়লে পশ্চিমা বিশ্বও পাল্টা আঘাত করতে পারে।”
ডিয়েল বলছেন, রুশ বাহিনীকে যদি ইউক্রেন থেকে পশ্চাদপসরণ করতে হয়- তাহলে রাশিয়া এ রকম কোনো আক্রমণ করার মত অবস্থানে থাকবে না।
“প্রকৃতপক্ষে পুতিন যদি একটা যুদ্ধ শুরু করে তা জিততে না পারেন এবং রুশ বাহিনীকে যদি ইউক্রেন ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হয়, তাহলে রাশিয়ার ভেতরে গণঅসন্তোষ এবং ক্রেমলিনের ভেতরে দ্বন্দ্ব তৈরি হবে।
“তখন রাশিয়া আর পশ্চিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অবস্থায় থাকবে না।”
সূত্র : বিবিসি