" />
এ দেশের প্রাকৃতিক দৃশ্য যেমন সৌন্দর্যময়, তেমনি এর অধিবাসীদের ধর্মীয় বিশ্বাসও বৈচিত্র্যময়। এ দেশের জনগণ মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী।আমাদের এ দেশ শান্তি ও সম্প্রীতির উর্বর ভূমি এবং বিচিত্র ধর্মবিশ্বাসের মানুষের এমন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বিশ্বে বিরল। তবে দুঃখজনক বিষয় হলো, ইদানীং একশ্রেণির দুর্বৃত্ত অপ্রীতিকর ঘটনার মাধ্যমে নষ্ট করতে চাইছে আবহমানকালের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। স্বার্থান্বেষী মহল দেশের সাম্প্র্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছে। মাঝেমধ্যে এমন কিছু ঘটনার প্রমাণ মিলছে খবরের কাগজে। সম্প্রতি ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় এক রাতেই ১২টি মন্দিরে ১৪টি প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। তা ছাড়াও সনাতনী সম্প্র্রদায়ের অন্যতম পবিত্র গ্রন্থ গীতাও ছিঁড়ে ফেলে দুর্বৃত্তরা। ইসলাম এ ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ সমর্থন করে না।
পৃথিবীর কোনো মানুষ, ধর্ম, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও কেন্দ্রকে অমর্যাদা করা ইসলামের শিক্ষা নয়। অমুসলিম ও সংখ্যালঘুদের অধিকারেও ইসলাম কঠোর নির্দেশ প্রদান করেছে। এ প্রসঙ্গে নবী করিম (সা.) বলেন, ‘জেনে রাখো, যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিম নাগরিক বা সংখ্যালঘুকে আঘাত করে বা তাকে অপদস্থ করে অথবা কর্মচারী নিয়োগ করে তার সাধ্যের বাইরে কাজ চাপিয়ে দেয়, আমি তার বিরুদ্ধে কিয়ামতের ময়দানে আল্লাহর দরবারে মামলা দায়ের করব’ (আবু দাউদ : ২/৪৩৩)। মহানবী (সা.) মদিনায় যখন একটি নতুন রাষ্ট্র স্থাপন করেন, তার ভিত্তি ছিল ‘মদিনা সনদ’। এই সনদের একটি ধারা হলো, সব ধর্মের লোক স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে। কেউ কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। মদিনার ইহুদিরা প্রায়ই ইসলামের বিরোধিতা করত, তথাপি রাসুল (সা.) তাদের ধর্ম পালনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেননি। একবার মদিনার মসজিদে বসে নবী করিম (সা.) নাজরান থেকে আগত একটি খ্রিস্টান প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। আলোচনার বিরতিতে তারা নিজ ধর্ম অনুসারে প্রার্থনা করার অনুমতি চাইলে নবী করিম (সা.) তাদের মদিনার মসজিদে প্রার্থনা করার অনুমতি দেন। (ফুতুহুল বুলদান : পৃ. ৭১)
ইসলাম সামগ্রিকভাবে পরমতসহিষ্ণুতা, সম্প্রীতি ও মানবতার শিক্ষা দেয়। অপরের প্রতি ঘৃণা বা অবজ্ঞা প্রদর্শন ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। প্রতিটি মানুষ, সে মুসলিম হোক বা অমুসলিম, নারী হোক কিংবা পুরুষ, মানুষ হিসেবে মহান আল্লাহ তাকে বিশেষ সম্মান ও মর্যাদা দান করেছেন। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করতেন। একবার আমাদের মহানবীর পাশ দিয়ে একটি লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তিনি ওই লাশের সম্মানে দাঁড়িয়ে গেলেন। তাকে বলা হলো লাশটি তো একজন ইহুদির। মহানবী (সা.) বললেন, ‘সে কি মানুষ নয়?’ (মুসলিম : ৯৬১)
অমুসলিমদের অধিকার ইসলামের ঐতিহাসিক সৌন্দর্য। ফিলিস্তিন জয়ের পর খলিফা ওমর ফারুক (রা.) বায়তুল মুকাদ্দাসের খ্রিস্টানদের একটি সংবিধান লিখে দিয়েছিলেন। তাতে বলা হয়েছে, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। এটি একটি নিরাপত্তা-সংক্রান্ত চুক্তিনামা, যা মুসলমানদের আমির, আল্লাহর বান্দা ওমরের পক্ষ থেকে স্বাক্ষরিত হলো। এ চুক্তিনামা ইলিয়্যাবাসী তথা জেরুজালেমে বসবাসরত খ্রিস্টানদের জানমাল, গির্জা-ক্রুশ, সুস্থ-অসুস্থ তথা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য প্রযোজ্য। সুতরাং চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর তাদের উপাসনালয়ে অন্য কেউ অবস্থান করতে পারবে না। তাদের গির্জা ধ্বংস করা যাবে না এবং কোনো ধরনের ক্ষতিসাধন করা যাবে না। তাদের নিয়ন্ত্রিত কোনো বস্তু, তাদের ধর্মীয় প্রতীক ক্রুশ ও তাদের সম্পদের কোনো ধরনের ক্ষতিসাধন বা হামলা করা যাবে না’ (তারিখে তাবারি : ২/৪৪৯)
অন্য ধর্মের অবমাননা, সমালোচনা ও নিন্দা ইসলাম কখনো সমর্থন করে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহকে ছেড়ে যাদের তারা ডাকে, তাদের তোমরা গালি দিও না। তাহলে তারা সীমা লঙ্ঘন করে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকেও গালি দেবে’ (সুরা আনআম : ১০৮)। সাম্প্রদায়িকতার মূলে কঠোর আঘাত হেনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদের ন্যায়বিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। ন্যায়বিচার করবে, ইনসাফ করবে- এটাই তাকওয়া’ (সুরা মায়িদা : ৮)। ইসলাম সর্বাত্মকভাবে সমাজ ও ব্যক্তি থেকে সাম্প্রদায়িকতার বীজ উৎখাতে ভূমিকা রেখেছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা ও প্রতিষ্ঠায় আজও যদি ইসলামের দীক্ষা ও দিকনির্দেশনার ব্যাপক প্রচার-প্রসার ও বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে নির্মূল হবে সাম্প্র্রদায়িকতা, বন্ধ হবে ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা। আল্লাহ সবাইকে বোঝার ও আমল করার তওফিক দিন।