" />
নিজস্ব প্রতিবেদক: ডাকাতির মামলায় কারাগারে থাকা অবস্থায় জঙ্গিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং জেএমবির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে জঙ্গিবাদে জড়ান মাসুকুর রহমান ওরফে রনবীর ওরফে মাসুদ। বর্তমানে তিনি নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র অন্যতম শূরা সদস্য ও সামরিক শাখার প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন।
কারাগার থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন সময়ে কারাগারে থাকা জেএমবি সদস্য ও তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র শূরা সদস্য এবং অর্থ ও মিডিয়া শাখার প্রধান রাকিবের সঙ্গে পরিচয় সূত্রে জঙ্গি সংগঠনে যোগ দেন।
সোমবার নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র শুরা সদস্য ও সামরিক শাখার প্রধান রনবীর ও তার সহযোগী বোমা বিশেষজ্ঞ বাশারকে কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য পেয়েছে র্যাব। মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান বাহিনীর মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
মঈন বলেন, ২৩ আগস্ট কুমিল্লা সদর এলাকা থেকে আটজন তরুণ নিখোঁজ হন। ২৫ আগস্ট নিখোঁজদের পরিবার কুমিল্লার কোতয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। র্যাব আট তরুণদের মধ্যে পালিয়ে আসা নিলয়কে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায়। পরে নিলয়কে র্যাব ডি-র্যাডিক্যালাইজেশন সেলের মাধ্যমে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে।
কমান্ডার মঈন বলেন, নিলয়ের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করে গত ৫ অক্টোবর কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ হওয়া রিফাতসহ নতুন জঙ্গি সংগঠনের ৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। যাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদে দেশে একটি নতুন জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় যার নাম ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’।
মঈন বলেন, র্যাবের গোয়েন্দা শাখা এবং র্যাবের বিভিন্ন ব্যাটালিয়ন সেপ্টেম্বর থেকে অদ্যাবধি বেশ কয়েকটি অভিযান চালিয়ে কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ ৮ তরুণের মধ্যে ৪ জনসহ নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র ৩৮ জন নেতা (বিভিন্ন পর্যায়ের) ও সক্রিয় সদস্য এবং ২০২১ সাল থেকে এই জঙ্গি সংগঠনকে সহায়তা দেওয়া এবং সামরিক প্রশিক্ষণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অপরাধে পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কেএনএফ-এর ১৪ নেতা ও সদস্যকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
কারা কোন দায়িত্বে:
বিভিন্ন পর্যায়ে গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদে র্যাবের গোয়েন্দা শাখা জানতে পারে, ‘জামাতুল আনসারের আমীর মো. আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ নামক ব্যক্তি। যার নেতৃত্বে উগ্রবাদী সংগঠনটি পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়াও উগ্রবাদী এই সংগঠনে ৬ জন শূরা সদস্য রয়েছে; যারা দাওয়াতী, সামরিক, অর্থ, মিডিয়া ও উপদেষ্টার দায়িত্বে রয়েছেন।
এদের মধ্যে- শূরা সদস্য আবদুল্লাহ মাইমুন দাওয়াতী শাখার প্রধান, গ্রেপ্তার মাসুকুর রহমান রনবীর সামরিক শাখার প্রধান, ইতোপূর্বে গ্রেপ্তার মারুফ আহমেদ সামরিক শাখার ২য় ব্যক্তি, মোশারফ হোসেন ওরফে রাকিব অর্থ ও গনমাধ্যম শাখার প্রধান, শামীম মাহফুজ প্রধান উপদেষ্টা ও প্রশিক্ষণের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক এবং ভোলার শায়েখ আলেম বিভাগের প্রধান হিসেবে সংগঠনটিতে দায়িত্ব পালন করছে।
এই নতুন জঙ্গি সংগঠনের ৫৫ জন সদস্যকে পাহাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ এর প্রধান নাথান বম, সামরিক কমান্ডার কথিত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ভাংচুং লিয়ান বম এবং অপর আরেক নেতা মিডিয়া শাখা প্রধান কথিত লে. কর্নেল লালজং মুই ওরফে মাওয়াইয়া এবং কথিত লে. কর্নেল লাল মুন ঠিয়াল ওরফে চির চির ময় এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে পার্বত্য চট্টগ্রামে আশ্রয় দিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে।
গত ২৩ জানুয়ারি ভোরে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা, র্যাব-২, র্যাব-৩ এবং র্যাব-১৫ এর যৌথ অভিযানে কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন ইয়াহিয়া গার্ডেনের গহীন বনাঞ্চল এলাকা থেকে সংগঠনের সূরা সদস্য ও সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমান রনবীর ও বোমা বিশেষজ্ঞ আবুল বাশার মৃধা ওরফে আলমকে গ্রেপ্তার করা হয়। উদ্ধার করা হয়, দেশি-বিদেশি অস্ত্র, গুলি, নগদ টাকাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর ভিডিও কন্টেন্ট।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তার সাত আসামির মধ্যে নব্য জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সামরিক শাখার উপ-প্রধান সৈয়দ মারুফ আহমেদ মানিক ছিলেন। গ্রেপ্তার মাসুকুর রহমান রনবীর সম্পর্কে কমান্ডার মঈন বলেন, ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ এর অন্যতম শূরা সদস্য ও সামরিক শাখার প্রধান। তিনি ২০০৭ সালের আগে পোস্ট অফিসে চাকুরি করতেন। ডাকাতির এক মামলায় গ্রেপ্তারের পর কারাগারে থাকা জঙ্গিদের সঙ্গে সাক্ষাত এবং জেএমবির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়।
জেল থেকে বের হওয়ার পর তিনি বিভিন্ন সময়ে কারাগারে থাকা জেএমবি সদস্য ও তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। ২০১৭ সালে জামাতুল আনসারের শূরা সদস্য এবং অর্থ ও মিডিয়া শাখার প্রধান রাকিবের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য হিসেবে জামাতুল আনসারে যোগদান করেন।
রনবীর সিলেট অঞ্চলে সংগঠনের দাওয়াতি ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমসহ সামরিক শাখার সদস্য নির্বাচন কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করতেন। সংগঠনের সামরিক শাখার বিভিন্ন নীতি নির্ধারণী বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি সংগঠনের আমীরের নির্দেশনায় কুমিল্লার পদুয়ার বাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি শূরা কমিটির মিটিংয়ের আয়োজন করেন।
এসব সভায় সংগঠনের সামরিক শাখার কার্যক্রমসহ বিভিন্ন নীতি নির্ধারনী বিষয়ে সিদ্বান্ত গৃহিত হয়। এছাড়াও ২০২১ সালে পাহাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রশিক্ষণ সেন্টারের সাথে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র চুক্তিপত্র স্বাক্ষরকালীন বৈঠকে রনবীরসহ অন্যান্য শূরা সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন।ওই বৈঠকে গ্রেপ্তার রনবীর পাহাড়ে সামরিক প্রশিক্ষণের রুপরেখা নির্ধারণ করেন।
২০২১ সালের নভেম্বর মাসে সিলেট থেকে ৪ তরুণের নিখোঁজের ঘটনায় তিনি জড়িত ছিলেন। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শেষে নিখোঁজ ওই ৪ তরুণকে সামরিক শাখায় নিযুক্ত করে। প্রায় ১ বছর পূর্বে সংগঠনের সামরিক শাখা প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার সামরিক কার্যক্রমের দুটি শাখা ছিল, যার একটি পাহাড়ে এবং অপরটি সমতলে। সমতলে সামরিক শাখার কার্যক্রম তার নেতৃত্বে পরিচালিত হতো। তিনি দেশব্যাপী সংগঠনের সাথে যুক্ত সদস্যদের সামরিক সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ ও সামরিক শাখার সদস্য নির্বাচন কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করতেন। তার নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে পাহাড়ে সামরিক শাখার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অপর একজন সদস্যকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তার নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণের জন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ ক্রয় করা হতো। তিনি বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষণ প্রদান ও তদারকির জন্য পার্বত্য অঞ্চলে গমন করতেন।
পাহাড়ে র্যাবের অভিযান শুরু হলে তিনি সিলেট, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আত্মগোপন করেন এবং কিছুদিন পূর্বে আত্মগোপনের উদ্দেশ্যে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকায় অবস্থান নেন।
কে এই আবুল বাশার:
গ্রেপ্তার আবুল বাশার মৃধা ওরফে আলম হাটহাজারীর একটি মাদ্রাসা থেকে পড়াশোনা শেষে মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। তার সাংগঠনিক নাম আলম। নিখোঁজ ৫৫ জনের তালিকায় আবুল বাশারের নাম রয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হুজি’র সাথে জড়িত ছিলেন।
হুজি সংগঠনে থাকাকালীন সময়ে ঝালকাঠির নলসিটি এলাকায় সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমের জন্য দায়েরকৃত নাশকতার মামলায় ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন বছর কারাভোগ করেন। ২০১৬-১৭ সালের দিকে জামাতুল আনসারের আমীর মাহমুদের মাধ্যমে জামাতুল আনসারে যোগ দেন।
পাহাড়ে প্রশিক্ষণের জন্য ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে গৃহত্যাগ করেন এবং ২ মাস সমতলের বিভিন্ন জায়গায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি রনবীর ও রাকিবের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য পার্বত্য অঞ্চলে যান। তিনি আইইডিসহ বিভিন্ন ধরণের বোমা তৈরিতে দক্ষ ছিলেন। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছ থেকে বোমা তৈরির বিষয়ে বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। জামাতুল আনসারের পাহাড়ে প্রশিক্ষণার্থীদের বিভিন্ন ধরণের বোমা তৈরি বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিতেন।
বয়সে বড় হওয়ার কারণে পাহাড়ে প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণী বৈঠকে যেকোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে সে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। পাহাড়ে র্যাবের অভিযান শুরু হলে তিনি ৫৫ জনের দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাহাড় থকে পালিয়ে সিলেটে যান। তিনি সামরিক শাখার প্রধান রনবীরের সঙ্গে সিলেট, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করেন। কিছুদিন পূর্বে সে রনবীরের সাথে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকায় আত্মগোপন করে।
পাহাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ এর প্রধান নাথান বম কোথায় জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, রনবীর জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, গত সেপ্টেম্বরের পর থেকে নাথান বমের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। জামায়াতুল আনসারের আমীরের সন্ধান ও আইনের আওতায় আনা সম্ভব হলে নাথান বম সম্পর্কে জানা যাবে।
কারাগারে গিয়ে নতুন জঙ্গি সংগঠনে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন রনবীর। এরআগেও অনেকে কারাগারে গিয়ে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হন। কারাগার কি তবে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধকরণের নিরাপদ জায়গা? এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো কার্যক্রম বা নজরদারি রয়েছে কিনা জানতে চাইলে মঈন বলেন, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও কারা কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়েছে রনবীর জিজ্ঞাসাবাদে কারাগারে থাকাকালেই জামাতুল আনসারে উদ্বুদ্ধ হবার কথা বলেছেন। এরকম অনেকেই উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। ২০০৫-০৬ সালের দিকে এটি বেশি হয়েছে। নতুন করে কারাগারে যাতে এই সুযোগ তৈরি না হয়, সেজন্য কারা কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।