এর আগে ১ সেপ্টেম্বর রওশনকে বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে সরিয়ে দিতে জাপার সংসদীয় দলের সিদ্ধান্ত লিখিতভাবে স্পিকার শিরীন শারমিনকে জানিয়েছিলেন মসিউর রহমান রাঙ্গা। ওই চিঠিতে বিরোধী দলের নেতার পদে পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে বসানোর জন্য বলা হয়েছিল। ওই দিন স্পিকারের দপ্তরে রাঙ্গার সঙ্গে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুসহ সংসদীয় দলের একাধিক এমপি উপস্থিত ছিলেন। জাপা মহাসচিব চুন্নু তখন জানিয়েছিলেন, ওই চিঠিতে তাঁদের দলের ২৬ জনের মধ্যে ২৪ জন এমপি সই করেছেন। জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে রওশন এরশাদকে সরাতে জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের চিঠি প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়েছেন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর কাছে এ আবেদন তিনি পৌঁছে দেন। এ সময় রওশনের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ তাঁর সঙ্গে ছিলেন।আগের চিঠি প্রত্যাহারের আবেদন স্পিকারের হাতে পৌঁছে দেওয়ার পর মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, সংসদীয় দলের সিদ্ধান্তের বিষয়ে তাঁর আগের দেওয়া চিঠি প্রত্যাহার করতে চান বলে স্পিকারকে জানিয়ে আসছেন। কারণ আগে যে চিঠি দেওয়া হয়েছিল, তার প্রক্রিয়ায় ভুল ছিল। তাই তাঁর সই করা আগের চিঠি প্রত্যাহারের জন্য স্পিকারকে বলেছেন। রাঙ্গা আরও জানান, স্পিকারের কাছে তিনি দলীয় গঠনতন্ত্রের কপিও দিয়ে এসেছেন। স্পিকার আইনগত দিক খতিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানিয়েছেন। সংসদ সচিবালয়ের আইন শাখার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অতীতে কোনো সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার পদে একজনকে সরিয়ে আরেকজনকে বসানোর নজির দেশে নেই। আইনানুযায়ী বিরোধীদলীয় নেতা সরকারের একজন মন্ত্রীর জন্য ধার্য বেতন-ভাতা ও অন্যান্য বিশেষাধিকার পাবেন। বিরোধীদলীয় নেতার অর্থ ‘স্পিকারের বিবেচনা মতে সময় সময়, যে সংসদ সদস্য সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য নিয়ে গঠিত দল বা অধিসংঘের নেতা’। এখানে জাপার দলীয় গঠনতন্ত্র বিবেচ্য বিষয় নয়।
তবে ইতোমধ্যে রওশন এরশাদের পক্ষে বক্তব্য দিয়ে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য পদসহ সব পদ থেকে অব্যাহতি পাওয়া মসিউর রহমান রাঙ্গা দাবি করেছেন, একই সময় জাতীয় পার্টির দুটি গঠনতন্ত্র। এক জায়গায় বলা আছে, প্রধান পৃষ্ঠপোষক সব কাজ করতে পারবেন। চেয়ারম্যান ও মহাসচিব তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করবেন। আর একটায় প্রধান পৃষ্ঠপোষকের কোনো খবরই নেই। গঠনতন্ত্র নকল করে আরেকটা করা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, ‘একটা দলের যখন মিটিং হয়; তখন সভাপতিত্ব যিনি করেন তিনি চিঠি দেবেন। তিনি (জি এম কাদের) সেটা না করে আমাকে দিয়ে করিয়েছেন। চিফ হুইপের এটা দেওয়ার কথা না। আমি মিটিং করেছি ৩১ আগস্ট। এমপিরা মিটিং করেছেন ১ সেপ্টেম্বর। এ তারিখের মিটিংয়ে আমার কাছ থেকে সই করিয়ে নেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, স্পিকারকে তিনি বলেছেন- এজেন্ডা না দিয়ে বৈঠক করা হয়েছে। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্তে যদি বিরোধীদলীয় নেতাকে বাদ দেওয়া হয় এবং উপনেতাকে সেই পদ দেওয়া হয়; সেটা হবে দুঃখজনক।
রাঙ্গা এখন কোন পক্ষে রয়েছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি দলের সঙ্গে রয়েছি। দলে আমাদের একসঙ্গে থাকতে হবে। দল একটাই থাকবে।’
সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাধারণত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়া রাজনৈতিক দল সংসদে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। প্রধান বিরোধী দলের সংসদীয় দলের সভায় বিরোধীদলীয় নেতা ও উপনেতা মনোনীত করা হয়। পরে বিষয়টি লিখিতভাবে জানানো হলে স্পিকার কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী পদক্ষেপ নেন।
তবে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর বর্তমান সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ (প্রয়াত) দলের কোনো বৈঠক ছাড়াই নিজেকে বিরোধীদলীয় নেতা এবং ভাই জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে ঘোষণা করে গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠান। এর পর ২০১৯ সালের ১০ জানুয়ারি এরশাদকে বিরোধীদলীয় নেতা ও জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেন স্পিকার।
পরে ওই বছরের ২২ মার্চ স্পিকারকে চিঠি দিয়ে জি এম কাদেরের পরিবর্তে রওশনকে বিরোধীদলীয় উপনেতা করার অনুরোধ জানানো হয়। পরদিন ২৩ মার্চ রওশনকে বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেন স্পিকার। ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই এইচএম এরশাদের মৃত্যুতে বিরোধীদলীয় নেতার পদ নিয়ে আবার লড়াইয়ে নামেন এরশাদপত্নী রওশন এবং ভাই জি এম কাদের। তাঁরা পাল্টাপাল্টি চিঠি পাঠান স্পিকারকে। পরবর্তী সময়ে অদৃশ্য হস্তক্ষেপে এই বিরোধের নিষ্পত্তি হয়। রওশন এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা এবং জি এম কাদের বিরোধীদলীয় উপনেতা নির্বাচিত হন।
কিন্তু রওশন এরশাদ দীর্ঘদিন ধরেই শারীরিক অসুস্থতার কারণে সংসদের কার্যক্রমে অনুপস্থিত ছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে গত ৩০ আগস্ট রওশন এরশাদের নামে একটি বিজ্ঞপ্তি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। তার সঙ্গে বিরোধীদলীয় নেতার কার্যালয়ের প্যাডে রওশনের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহর নামে একটি চিঠিও ছিল। তিন পৃষ্ঠার ওই বিজ্ঞপ্তিতে দলের ভেতরকার রাজনীতির নানা বিষয় বর্ণনা করে আগামী ২৬ নভেম্বর দলের সম্মেলন আহ্বান করেন রওশন। নিজেকে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক করে ৮ সদস্যের একটি কমিটিরও ঘোষণা দেন।
এর প্রতিক্রিয়ায় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের প্রেস সচিব খন্দকার দেলোয়ার জালালী এক বিবৃতিতে বলেন, দলের কাউন্সিল ডাকার এখতিয়ার রওশনের নেই। তাঁর পদক্ষেপ অবৈধ। পরদিন রওশনকে বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকেও অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয় জাপার সংসদীয় দল। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ রাঙ্গার সইয়ে এমন চিঠি স্পিকারের কাছে দেওয়া হলেও পরে তিনি একটি টিভি চ্যানেলে এ সিদ্ধান্তের বিপক্ষে বক্তব্য দেন। এর জের ধরে ১৪ সেপ্টেম্বর দলের সব পদ থেকে মসিউর রহমান রাঙ্গাকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়।