চার ছেলেমেয়ে নিয়ে মারুফার কৃষক বাবা মোহাম্মদ আইমুল্লার কঠিন জীবন। বড় মেয়েকে বিয়ে দিলেও দুই ছেলে ও এক মেয়ের ভরণ-পোষণ করতে পরিশ্রম বেশিই হয়ে যাচ্ছিল। এমন অবস্থায় হতদরিদ্র বাবার কাজে সাহায্য করার বদলে ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন দেখা মারুফার কাছে অন্যায় মনে হতো। তার পরেও স্বপ্ন দেখা থামাননি। ঢাকা লিগের সাফল্যই শেষ পর্যন্ত জাতীয় লিগে সুযোগ করে দিয়েছে। সেখানে ভালো করে জাতীয় দলেও সুযোগ পেয়ে গেছেন এই অলরাউন্ডার।
হার্দিক পান্ডিয়ার দারুণ ভক্ত মারুফা আক্তার। ভারতীয় অলরাউন্ডার দুই ভূমিকায় কতটা কার্যকরী তার প্রমাণ চলমান এশিয়া কাপেই দেখা গেছে। ভারতের এই তারকার মতো ব্যাট-বলে বাংলাদেশকে সাফল্যে ভাসাতে চান এই নারী ক্রিকেটারও। বৃহস্পতিবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব খেলতে দেশ ছাড়ার আগে সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছিলেন ক্ষুদে এই ক্রিকেটার। সেখানেই প্রিয় ক্রিকেটার হিসেবে ভারতীয় পেস বোলিং অলরাউন্ডার হার্দিক পান্ডিয়ার কথা জানিয়ে গেছেন।করোনা মহামারী শেষ হওয়ার পর ওয়ানডে ফরম্যাটের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে বাজিমাত করেছেন। ডানহাতি এই পেসার বিকেএসপির হয়ে ১১ ম্যাচে ওভারপ্রতি ৩.২১ রান দিয়ে নেন ২৩ উইকেটও। যার মধ্যে এক ম্যাচেই ৭ উইকেট নেওয়ার নজির রেখেছেন। এরপর গত মাসে সিলেটে টি-টোয়েন্টি সংস্করণের জাতীয় লিগে দেখান আরও বড় চমক। ২.৭৬ ইকোনমিতে বোলিং করে ৭ ম্যাচে ১৩ উইকেট নিয়ে হয়েছেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শিকারি। সিলেট বিভাগের শিরোপা জয়ে রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও। চমক জাগানিয়া এই পারফরম্যান্সের পর স্বাভাবিক ভাবেই বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের দলে সুযোগ পেতে নির্বাচকদের নজরে পড়ে গেছেন।সেই ক্রিকেটারটিকেই দেশ ছাড়ার আগে যখন প্রশ্ন করা হলো- কাকে বেশি অনুসরণ করেন? উত্তরে মারুফা সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘হার্দিক পান্ডিয়া।’ কেন জানতে চাইতেই তার সাবলীল উত্তর, ‘আমার মতো এজন্য।’
আবেগ লুকানোর কাজে খুব একটা পারদর্শী নন পান্ডিয়া। আবার মনে যা আসে, সেটাও নির্দ্বিধায় বলে ফেলেন। এই অদক্ষতা সত্ত্বেও ক্রিকেটীয় দক্ষতার জোরে তিনি ঠিকই সামনে এগিয়ে গেছেন। মারুফা অবশ্য বেশ স্বল্পভাষী। তবে পান্ডিয়ার মতো চোখে-মুখে স্পষ্টই ফুটে উঠে আবেগ।গত বছরের জানুয়ারিতে মারুফার কয়েকটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে গণহারে। দেখা গেছে মারুফা তার বাবাকে কৃষি জমি তৈরিতে সাহায্য করছেন। সাধারণত ট্রাক্টর কিংবা হাল দিয়ে জমি চাষাবাদের উপযোগী করা হয়। কিন্তু নিজেদের গরু কিংবা মহিষ না থাকায় কিছুই করার ছিল না। এ অবস্থায় বাবার সঙ্গে ক্ষেতে নেমে পড়েন মারুফা। সর্বশক্তি দিয়ে কাঁদায় মাখামাখি হয়ে মই টেনে জমি সমান করার কাজ করেছেন। ফেসবুকে এই ছবি দেখে মারুফার জন্য অনেকরই মন কেঁদে ওঠে। এরপর বাংলা ট্রিবিউনকে সংবাদ প্রকাশের পর বিসিবি দায়িত্ব নেয় মারুফার। তার কৃষক বাবা এখন মহাখুশি। মারুফার কথায়, ‘উনারা (বাবা-মা)অনেক খুশি হয়েছে যে, আমি এই পর্যন্ত আসতে পেরেছি। বাবা খুশি হয়েছে। বলে যে আরও ভালো খেলতে হবে।’মারুফার মূল অস্ত্র ইনসুইং। তার গতিময় ইনসুইংয়ের কারণে বিভ্রান্ত হন ব্যাটাররাও। অধিনায়ক নিগার সুলতানা তাই তো মারুফাকে ট্রার্মকার্ড হিসেবে দেখছেন। আর সেটি হলে বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দলেরই লাভ। তবে জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া মারুফা কী পেয়েছেন, সেটা এখনও পুরোপুরি অনুভব করতে পারছেন না। অধিনায়ক নিগার সুলতানা জোত্যির কথাতেই সেটি বোঝা গেলো, ‘প্রথম যখন সিলেট থেকে আসি, আমার রুমমেট ছিল। আমাদের রুম থেকে এয়ারপোর্টও দেখা যায়। তো ও(মারুফা) বলছিল, আমি কি প্লেনে উঠবো। অনেক ছোট যেহেতু, তাই রোমাঞ্চিত। তবে ও আসলে এখনো বুঝতে পারছে না, কী পেতে যাচ্ছে বা কী পেয়েছে। এটাই এখন বেস্ট ওর জন্য- না বুঝতে পারা। বুঝে গেলে অনেক কিছু চিন্তা আসে, এখন শুধু নিজের পারফরম্যান্স নিয়েই চিন্তা করতে পারবে।’তার পরেও মারুফাকে নিয়ে দারুণ আশাবাদী জোত্যি, ‘‘যদি বলা হয়- ‘মারুফা তুমি করতে পারো’, তখন ভালো করতে পারে। অন্যান্য চিন্তা থাকে না। পাশাপাশি দুর্দান্ত ফিল্ডারও। যা দলের জন্য প্লাস পয়েন্ট। আমি অনেক আশাবাদী, ও (মারুফা) দলের জন্য কিছু করতে বললে অবশ্যই করে দেবে।’এদিকে নারী দলের কোচ ও ম্যানেজার মঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জু মারুফাকে নিয়ে বলেছেন, ‘ওকে (মারুফা) কেউ আনে নাই, ও (মারুফা) নিজের জায়গা করে নিয়েছে। পারফরম্যান্স দেখলেই বুঝবেন, শুধু বোলিং না, ছয়-সাতে ব্যাটিংয়ে অবদান রেখেছে টি-টোয়েন্টিতে যেমন দরকার হয়।’