সম্প্রতি বারসেলোনার একটি বিজ্ঞান সম্মেলনে বিজ্ঞানী আন্দ্রেয়াস পামের নেতৃত্বে সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল গবেষক একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। গবেষকদের দাবি, মানুষের নাক ডাকার পিছনে একটি বড় কারণ ‘অবসট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া’ বা ‘ওএসএ’। এই সমস্যার জেরে নাকের ভিতর দিয়ে বায়ুপ্রবাহের পথটি রুদ্ধ হয়ে আসে। তাই শব্দ হয় ঘুমের সময়। বিজ্ঞানীরা চার হাজার ২০০ জন ওএসএ রোগীর উপর এই গবেষণাটি চালান। দেখা যায়, রোগীদের প্রায় অর্ধেকই শেষ পাঁচ বছরের মধ্যে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন।
বিকট নাক ডাকার আওয়াজ খুবই বিরক্তিকর। যিনি নাক ডাকেন তিনি কোনওভাবেই বুঝতে পারেন না যে তিনি নাক ডাকছেন। পাশের মানুষটি তাকে সমস্যার কথা বললেও তিনি বিশ্বাস করতে চান না। সারা বিশ্বে পুরুষ-নারী নির্বিশেষে প্রায় ৪৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এই সমস্যায় ভোগেন। প্রায়ই আমরা নাক ডাকা নিয়ে হাসিঠাট্টা করলেও নাক ডাকার স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি নিয়ে সতর্ক করছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি সুইডেনের গবেষকরা দাবি করেছেন, যারা নাক ডেকে ঘুমান, তাদের ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশ অনেকটাই।
সমীক্ষা অনুযায়ী নাক ডাকেন এমন ব্যক্তির অতিরিক্ত ওজন, ডায়াবেটিস, ধূমপান বা প্রচুর পরিমাণে অ্যালকোহল সেবনের অভ্যাস থাকলে ঝুঁকির মাত্রা অনেক বেড়ে যায়।
দেখা গেছে, বিকট শব্দে নাক ডাকা ব্যক্তির শিরায় রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকির মাত্রাও বেশি। এমন অবস্থা জীবন বিপন্ন করার মতো পরিস্থিতিও তৈরি করে।
বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, বহু ওএসএ রোগীর মধ্যেই স্থূলতা, ডায়াবেটিসের মতো সমস্যা দেখা যায়। অতি আগে ভাবা হত সেগুলোই ক্যানসারের আশঙ্কা বাড়ায়। নতুন পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, এই সমস্যায় ভোগা মানুষদের মধ্যে রক্তে তুলনামূলকভাবে অনেক দ্রুত অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। বিশেষ করে ঘুমের মধ্যে বেশি দেখা যায় এই সমস্যা। দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে এই অক্সিজেন হ্রাসের সমস্যাই বাড়িয়ে দেয় ক্যানসারের ঝুঁকি।
চিকিৎসকের মতে, নাক ডাকা বন্ধ করার অনেক সহজ রাস্তা আছে। বিনা ওষুধেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
আর্দ্রতার অভাব
স্বাস্থ্য ভালো রাখতে এবং নাক ডাকা বন্ধ করতে হলে ভিতর থেকে আর্দ্র থাকতে হবে। যদি শরীরে আর্দ্রতার অভাব থাকে তাহলে তাহলে নাকের ভিতরের তরল শুকিয়ে যায়। যার জন্য বায়ু ঠিকমতো আসা যাওয়া করতে পারে না। পুরুষদের প্রতিদিন ৩-৪ লিটার ও মহিলাদের প্রতিদিন ২-৩ লিটার পানি পান করতে হবে।
শরীরের বাড়তি ওজন
শরীরের বাড়তি মেদ ঝরিয়ে ফেললে নাক ডাকা বন্ধ হয়ে যায়। মোটা মানুষদের ঘাড়ে বাড়তি কিছু টিস্যু থাকে। যার দরুন তাদের শ্বাসপ্রশ্বাসের রাস্তা ছোট হয়ে যায়। সেই কারণেই ওজন কমে গেলে নিজে থেকেই নাক ডাকা বন্ধ হয়ে যায়।
শোয়ার পজিশন
পিঠের দিকে ভর দিয়ে চিত হয়ে শুলে নাক ডাকে। কারণ চিত হয়ে শুলে টিস্যু বর্ধিত হয়ে এয়ার প্যাসেজ ছোট করে দেয়। যদি কোনও এক পাশে কাত হয়ে শোয়া যায় তাহলে নাক ডাকা অনেকটাই কমে যায়।
নাকের প্যাসেজ বন্ধ
নাক যদি বন্ধ হয় তাহলেও নাক ডাকার সমস্যা হতে পারে। নাকের রাস্তা বন্ধ হলে বায়ু ঠিকমতো চলাচল করতে পারে না ফলে শব্দ হয়। এর জন্য গরম তেল মালিশ করা যেতে পারে বা ন্যাজাল ড্রপ ব্যবহার করা যেতে পারে। শুতে যাওয়ার আগে উষ্ণ পানিতে গোসল করলেও কিছুটা হলেও সমস্যার সমাধান হয়। এতে নাকের প্যাসেজ খুলে যায়।
ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ করা
গবেষকরা বলেন যে নাক ডাকার অন্যতম কারণ হল ওয়েডিমা ও আপার এয়ারওয়ে প্যাসাজ বন্ধ হয়ে যাওয়া। আর এগুলো অনেক সময় হয়ে থাকে ধূমপান ও মদ্যপানের জন্য। এগুলো বন্ধ করলে নাক ডাকাও কমে যায়।
ব্যায়াম করুন
খুব হাল্কা কিছু ব্যায়াম করুন, যা আপনার গলা ও মুখের পেশীকে শক্তিশালী করবে। এছাড়া প্রাণায়ম অভ্যাস করুন। এরফলে শ্বাসক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হয়। রক্তসঞ্চালনও ভালো হয়। ঘুম ভালো হয়।
নাক ডাকা রোধে ঘরোয়া টোটকা
হলুদ গুঁড়া: এক কাপ গরম দুধে ২ চা-চামচ হলুদ গুঁড়া মিশিয়ে প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় খেয়ে নিন।
মাখন: সামান্য একটু মাখন গরম করে, ঘুমাতে যাওয়ার আগে নাসিকারন্ধ্রে লাগিয়ে নিন।
এলাচ গুঁড়া: এক গ্লাস গরম পানিতে আধ চামচ এলাচ গুঁড়া মিশিয়ে, প্রতিদিন শুতে যাওয়ার আগে খেয়ে নিন।
পুদিনাপাতা: পুদিনাপাতাকে ঈষদুষ্ণ পানিতে মিশিয়ে গার্গল করুন। দেখবেন সমস্যা কমছে। এক্ষেত্রে প্রথমে গরম পানিতে পুদিনপাতা ফেলে গরম করুন। তারপর সেই পানি ঠান্ডা হতে দিন। সহনযোগ্য অবস্থায় এলে গার্গল করুন।
দারচিনি: দারচিনির গুণ প্রশ্নাতীত। প্রতিদিন একগ্লাস ঈষদুষ্ণ পানিতে দারচিনির গুঁড়ো মিশিয়ে নিন। তারপর সেই পানি দিয়ে করুন গার্গল।
রসুন: আয়ুর্বেদে রসুনকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। রসুন শরীর ভালো রাখার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে কার্যকরী। এক্ষেত্রে ঈষদুষ্ণ পানিতে মিশিয়ে নিন রসুন। তারপর সেই পানি দিয়ে করা হোক গার্গল। দেখবেন ভালো রয়েছেন।
অলিভ তেল: ঘুমানোর কিছুক্ষণ আগে মাত্র কয়েকদিন এক ফোঁটা করে অলিভ তেল নাকে দিন। দেখবেন নাক ডাকার সমস্যা কমছে। কারণ এক্ষেত্রে অলিভ তেল নাকের ভিতরের অংশ পরিষ্কার করে দেয়।
ঘি: নাক ডাকা সমস্যা সমাধানে ঘি হতে পারে আপনার অন্যতম হাতিয়ার। এক্ষেত্রে ঘি সামান্য গরম করুন। সহনযোগ্য অবস্থায় এলে সামান্য ঘি দুই নাকে দিন। দেখবেন কিছুদিনের মধ্যেই ফল পাচ্ছেন।
সিলিকন রিং: এটি একটি নরম সিলিকন রিং। আলগোছে নাকের ভেতর ঢুকিয়ে রাখুন। এর থেরাপিউটিক চুম্বক দুটিও বেশ কাজের। ডিভাইসটি পরা থাকলে ঘুমের মধ্যেও নাকের স্পর্শকাতর ইন্দ্রিয়গুলো নিজের মতো সক্রিয় থাকে। নাসিকারন্ধ্র প্রশস্ত থাকে ফলে শ্বাস-প্রশ্বাস খুব সহজেই ভেতরে যেতে ও আসতে পারে। ফলে নাক ডাকা বন্ধ হয়ে যায়।